পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১০৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

কথা, বলেছিলেন বিকল্প চেতনা বিকল্প নন্দন বিকল্প বয়নের কথা। বড়ো কিছু পাওয়ার জন্যে স্থলন ঘটে না। সাধারণত টুকিটাকি লোভ, নগদ বিদায়ের আকাঙ্ক্ষা, যূথবদ্ধতার নিরাপত্তা-এইসব এত বেশি চোখে পড়ে যে ‘দ্রষ্টা চক্ষু’র উদ্ভাসনের জন্যে দীর্ঘ প্রস্তুতি, তিতিক্ষা ও ধৈর্য সম্পর্কে অনীহা ক্রমশ প্রবলতর হয়ে ওঠে। সমকাল যদিও সমস্ত অর্জনের আধার, মনে রাখতে হয় একথাও যে বর্জ্য পদার্থও এই সমকালই উৎপাদন করে চলেছে। এ বড় সুখের সময় নয়, এ বড় আনন্দের সময় নয়—একথা লিখেছিলেন শক্তি, শক্তি চট্টোপাধ্যায়। এও একরকম করে জানা যে এ সময় কেন্দ্রচ্যুতির, গতিহীন পরিক্রমার। যখন ‘পা থেকে মাথা পর্যন্ত টলমল করে দেয়ালে দেয়াল কার্নিশে কার্নিশ ফুটপাত বদল হয় মধ্যরাতে। এও একধরনের নিবিড় দেখা যে জুতো হাঁটছে। পা রয়েছে স্থির। সমস্ত কিছুকে এতোলবেলোল করে দেয় সত্তাশূন্য রিক্ত কাল, প্রতিবেদনের বয়নে অন্তর্বয়নে এর স্বীকারোক্তি থাকবেই।

 আবার, সত্য তো একান্তিক নয়। লেখা তো একবাচনিক নয় কখননা। সূত্রধার-সত্তার প্রবল শীৎকার যেমন অনস্বীকার্য, তেমনি অনিবার্য সত্তার দ্রোহ ও ঘৃণায়-বিদ্রুপে-ক্ষোভে গড়ে-ওঠা বারুদ-প্রহর। তখন বাংলা পদ্যের এবং গদ্যের ধারণক্ষমতা শানিত হয়ে ওঠে আরও, সত্যের মুখখামুখি হওয়ার কৃৎকৌশল রপ্ত করে নেয় লেখা। আশপাশকে দেখে নেওয়ার জন্যে যতখানি শক্তি অর্জন করা আবশ্যিক, সে-সময় লেখায় তা জেগে ওঠে। সুবিমল মিশ্রের ভাষায়, তখন ‘নাঙা হাড় জেগে উঠছে’—এই বার্তা প্রচার করে লেখা। হয়ে ওঠে শক্তিশালী হাতুড়ির বিকল্প যা দিয়ে অচলায়তনের পাথুরে দেওয়াল ভেঙে ফেলা যায়। আলু-পটলের মতে, প্রসাধনসামগ্রীর মতো, স্যানিটারি ন্যাপকিনের মতো সাহিত্যকর্মকে হাটেবাজারে বিক্রি করার জন্যে চোখ-ধাঁধানোে বিজ্ঞাপনের জৌলুস তৈরি করা হচ্ছে যখন—সে-সময় তথাকথিত সাহিত্যের উল্টো মেরুতে দাঁড়িয়ে থাকছে লেখা, আমাদের লিখনপ্রণালী। সুবিমল মিশ্র এই প্রণালীর চমৎকার উপস্থাপক। তিনি, সুবিমল মিশ্র, গত তিরিশ বছর ধরে প্রাতিষ্ঠানিক চিন্তাশৃঙ্খলকে ভেঙে-ভেঙে ওই সাহিত্যকর্ম নামক কিংবদন্তিকে ধ্বস্ত করেছেন, স্বাধীন সূত্রধার-সত্তাকে দিয়ে প্রতাপের যাবতীয় চক্রান্ত মোকাবিলা করিয়েছেন। সমস্ত বহুত্বের দ্যোতনা জন্ম নিচ্ছে যে তীব্র বিস্ফোরক আঁতুড়ঘরে, তার নাম জীবন। আর, এই জীবনের দিকে খোলা চোখে তাকাতে-তাকাতে বিস্ময়ের, বেদনার, স্বপ্নের, আনন্দের, শৌর্যের আর শেষ নেই তার। গত তিরিশ বছর ধরে তার পরিক্রমা আসলে লেখার অবিরল প্রবাহ, পাঠকৃতির অর্থাৎ টেক্সটের বহুস্বরিক হওয়া আর হয়ে ওঠা। বিনির্মাণ আর পুনর্নির্মাণের এই যুগলবন্দিতে যতটুকু বদলে যাচ্ছে সূত্রধারসত্তা, ঠিক সেই পরিমাণে পুনর্বিন্যস্ত হচ্ছে জীবনবোধ।

 প্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্যে এই নবায়ন ঘটে না, ঘটতে পারে না। সেখানে মলাট পালটে যায় মুহুর্মুহু কিন্তু ভেতরের শাঁস বা শাসহীনতা একই থেকে যায়। অথবা ভেতরের ওই শাঁসাভাসে যত পচন ধরতে থাকে, বাইরের মলাটে তত জটিল রঙ আর দামি এসেন্স যুক্ত হয়। কিন্তু পচাইয়েরও একটা নিজস্ব আমোদ থাকে যা কিনা ভয়াবহভাবে

১০৪