পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১১২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

পুনরাবিষ্কার করতে হয়, ঘৃণাকে যুক্তির একমাত্র আধার ও আধেয় করলে মূল উদ্দেশ্যই নষ্ট হয়ে যাবে। বিশেষত আজকের এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থায় বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমের অভূতপূর্ব সন্ত্রাস যখন বিশ্বপুঁজিবাদের আধুনিকোত্তর পর্যায়কে আধা-ঔপনিবেশিক সমাজের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে—সে-সময় বর্ণবাদের পুনরুত্থান মূল লড়াইকে পিছিয়ে দেবে। নয়াবর্ণবাদী গোষ্ঠী ঘৃণাকে মৌল উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করতে গিয়ে যে-ধরনের সাহিত্যবোধকে উসকানি দিয়ে চলেছে, তাতে সাংস্কৃতিক সংগ্রামের বারুদ যেমন নুলো-খোঁড়া-অন্ধ-বধিরদের মধ্যে হারিয়ে যাবে—তেমনি ভূলুণ্ঠিত হবে লেখার পতাকা।

 সন্দেহ নেই যে বিপন্ন এ সময়। নইলে মানুষের দুনিয়া কেন বল্মীকের স্তুপ হয়ে যাচ্ছে। কেন এত সংশয়ের কুয়াশা, এত গণ্ডির পরে গণ্ডি! যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ কেন চোখে দ্যাখে তারা? শুধু কেন গণ্ডির গাথারচনা আর মানুষকে নানা ছলে নানা অজুহাতে কেবলই টুকরো করে আনার আয়োজন। সাহিত্যের নামে অচলায়তন আর চক্রব্যুহ গড়ে তোলা হয়েছিল বলেই তো লেখাকে আয়ুধ হিসেবে তুলে নিয়েছিলেন সত্তার উপাসকেরা। একদিকে বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমের অজস্রতার দাপটে লেখার প্রক্রিয়াকে ভোঁতা করে দেওয়ার চেষ্টা এবং অন্যদিকে লেখার গ্রহীতাদের মধ্যে বিপুল বিভ্রান্তি তৈরির প্রয়াস। আয়ুধে যদি মরচে ধরিয়ে দেওয়া যায় কিংবা লক্ষ্যভ্রষ্ট করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা যায়—তাহলে বিশ্বজোড়া ফাঁদ পেতে-দেওয়া আধিপত্যবাদীদের আর পায় কে? নগদবিদায়ের লোভে যত বেশি ছোট্ট ছোট্ট বৃত্ত মেনে নিচ্ছেন লিখিয়েরা, তত বেশি লেখার তাৎপর্য মুছে যাচ্ছে। স্বপ্ন নেই, কল্পনা নেই, আত্মবিনির্মাণ। নেই। স্বপ্নশূন্য জীবনে লেখা হয় না, হতে পারে না। কারা কীভাবে স্বপ্নকে শুষে নিচ্ছে অহরহ, সেকথা যতক্ষণ বুঝতে না পারছি অন্তত ততক্ষণ জীবনের পাঠকৃতি তৈরি হবে না। আবার পাঠকৃতি মানে পাঠক। যত পাঠক তত পাঠ অর্থাৎ তত লেখার বিচিত্র বিন্যাস। এই পাঠকসত্তার উপর যদি আক্রমণ নেমে আসে, লেখাও অবধারিত ভাবে নিরালম্ব হয়ে পড়বে। একটু আগে বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমের দাপটের কথা লিখেছি যাতে যাবতীয় সামাজিক সময় ও পরিসর মুছে যাচ্ছে। কাঁঠালের রসে আটকে যাওয়া মাছির মততা, পিঁপড়ের মতো মানুষ আজ বিনোদনের নেশায় বন্দী। কোথাও আজ পড়ার অবকাশ নেই, তাই পাঠকসত্তাও বিকশিত হতে পারছে না।

 অথচ সম্ভাব্য পাঠকের উদ্দেশে চিরকাল লিখিয়েরা তাদের যাবতীয় আকাঙ্ক্ষা নিবেদন করেছেন। সুতরাং গত দু-তিন বছরে ওই পাঠকসত্তার অস্তিত্ব যত অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে, লেখা থেকে তত ঝরে যেতে বসেছে আলো ও গতির সম্ভাবনা। মূল লড়াই যদিও পণ্যায়ন ও বিনোদনের সঙ্গে, সেকথা ভুলে গিয়ে আত্মহননের মাদকে রপ্ত হতে চাইছেন কোনো কোনো একদা-যোদ্ধা। বানিয়ে-তোলা পাঠকের আদলে। খুঁজতে চেয়েছেন আত্মরক্ষার প্রকরণ। কিন্তু সত্যভ্রম যেমন সত্যকে আড়াল করে, তেমনি পাঠভ্রম ঝাপসা করে দেয় পাঠকসত্তাকে। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক অভ্যাসের ফাঁদে

১০৮