পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১২৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

কর্মপথে চলতে চলতে তাকে অবসর যাপন বা বিনোদন করতে হয়েছে যৌথভাবে, সঙ্গে সঙ্গে গড়ে তুলেছে যৌথ উৎসব ও যৌথ সংস্কৃতির রীতিনীতি। সময়ের সঙ্গে পাকে-পাকে বাঁধনে জড়িয়েছে নিজেকে, আবার বাঁধন খুলতে খুলতে এগিয়েছে। মাটিতে পা রেখে তার আকাশপানে চাওয়া, আবার আকাশ বিহারে ক্লান্ত হয়ে মাটির নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে ফিরে আসা। ব্যক্তি যুক্ত হতে চায় সমষ্টির সঙ্গে, কিন্তু বিযুক্তির যন্ত্রণাও সইতে হয় তাকে। জীবন চায় বিস্তার অথচ পদে পদে কেবলই সংকোচন, বিচ্ছেদ ও মৃত্যুর ভ্রুকুটি। সময়ের যে-যাত্রার কথা একটু আগে লিখেছি, তার মধ্যে কোনটা চিরকালীন আর কতটাই বা চিরকালীনতা, মানুষই তার রুচি ও প্রয়োজন মাফিক ঠিক করে নেয়। তার সংস্কৃতি-চিন্তায় তাই কিছু কিছু ধ্রুববিন্দু অর্থাৎ ভাবাদর্শের গ্রন্থনা থাকবেই পুড়েও যা পোড়ে না, বিক্ষত হয়েও যা বিদীর্ণ হয় না। আবার সমসাময়িক অভিজ্ঞতাও উপেক্ষা করা চলে না। মান্যতা দেওয়ার জন্যে নয়, অবহিত হওয়ার জন্যেও। কিন্তু যৌথ উপলব্ধি ও যৌথ উদ্যোগে যেসব সংস্কৃতি-যোদ্ধারা বিশ্বাসী, তারা ক্ষণিকের মুঠি দাও ভরিয়া’ বলে থেমে যান না; প্রকৃত কালের চিহ্নায়কগুলিকে শনাক্ত করতে চান। নইলে মন্থর হবে যে মানুষের এগিয়ে যাওয়ার গতি, ক্ষণকালের প্রতি অতি প্রশ্রয়ে সহস্র শৈবালদাম এসে বাঁধবে স্বপ্নময় আকাঙ্ক্ষাকে—এসম্পর্কে তারা সচেতন। তাই তাদের সংগ্রাম নিরন্তর ভেতরে ও বাইরে চলতে থাকে ভাবাদর্শহীনতার নৈরাজ্য ও প্রতিভাবাদর্শের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে। চলতে থাকে আত্মদীপ হয়ে ওঠার জন্যে, বহুবাচনিক জগতের দীপাধার হওয়ার জন্যে। তাদের দায়বদ্ধতা সেই সৃষ্টির কাছে যা দ্বন্দ্বময় সংগ্রামের ভাষা, আবার সেই সংগ্রামের কাছেও যা সৃষ্টির প্রেরণায় ছন্দোময়।

 সংস্কৃতি কেন: এই মৌলিক প্রশ্নের উত্তর চাইতে গেলে আগে ঠিক করে নিতে হবে আমাদের বিশ্ববীক্ষা কী? অর্থাৎ কোন দৃষ্টিতে জীবনকে দেখছি আমরা? বাস্তব অভিজ্ঞতার বাস্তব বিশ্লেষণ করছি নাকি মনগড়া ভাবনায় বুদ হয়ে কল্পলোকের কথকতা করছি! এবং, করছি কাদের স্বার্থে? সংস্কৃতি-চর্চায় আমরা যদিও স্বাধীনতার দোহাই দিই, আসলে আমরা কতটা স্বাধীন! অর্থাৎ কোনও অদৃশ্য বাজিকরের পুতুলনাচনের খেলায় মোহগ্রস্ত হয়ে আমরা নাচন-কোঁদন করা পুতুলদের মধ্যে ঢুকে পড়িনি তো! একদিকে সাগর-পারের মুরুব্বিদের চোয়া চেঁকুর এবং অন্যদিকে স্বদেশি মৌলবাদী পাঁচন—এতদিন এদের সঙ্গে সহাবস্থান করে এবার কীভাবে সম্মিলিত ফ্যাসিবাদী ফাস এড়িয়ে যাব? নতুন সময় মানে নতুন ফাঁদ এবং নিশ্চয় ফাঁসুড়েদের আক্রমণ প্রতিহত করার নতুন কৌশলও। নতুন সময়ে নতুন ভাবে নির্ণীত মূল্যবোধের জন্যে আমাদের সাংস্কৃতিক বিশ্ববীক্ষাকেও নতুনভাবে বিন্যস্ত করে নিতে হবে। কতদিন আমরা আয়নার সামনে দাঁড়াইনি। নিত্য নতুন মুখোশ পরার প্রবণতায় আমরা নিজেরাই প্রকৃত মুখকে ভুলে থেকেছি কতদিন! ফাঁপা বৌদ্ধিকতার গর্বে চলিষ্ণু জনতার জীবন-প্রবাহ থেকে সরে দাঁড়িয়ে সাংস্কৃতিক চেতনাকেও লাঞ্ছিত করেছি। সামাজিক মূল্যবোধের ক্ষয়কে আমরা যদি যথাপ্রাপ্ত বাস্তব বলে মান্যতা দিই, তাহলে তা তো বৈধতা পাবেই।

১২২