আবার শমীগর্ভে প্রচ্ছন্ন আগুনের মতো অপ্রাতিষ্ঠানিক সময়বোধের দ্বিবাচনিক অভিব্যক্তিও দেখতে পাচ্ছি আমরা। নইলে হাসান আজিজুল হক-আখতারুজ্জামান ইলিয়াস লিখতেন না, ইমদাদুল হক মিলন আর হুমায়ুন আহমেদেরা লিখতেন কেবল। কিংবা মহাশ্বেতা দেবী, সাধন চট্টোপাধ্যায়, স্বপ্নয়ম চক্রবর্তী, ভগীরথ মিশ্র, অমর মিত্র, কিন্নর রায়, নবারুণ ভট্টাচার্যের লিখতেন না কখনো। আজও সুবিমল মিত্র, উদয়ন ঘোষ, কাজল শাহনেওয়াজেরা লেখেন কেন যদি সময়ের প্রতীয়মান ও প্রশ্রয়ধন্য পাঠ সম্পর্কে তাদের আপত্তি না থাকত? অবভাস আমাদের চিন্তায়, চেতনায় মড়কের সংক্রামক কীটের মতো অনুপ্রবেশ করেছে। সত্য কী আমরা জানি না, এমন কী মিথ্যাকেও আমরা জানি না। আমরা ইতিহাসকে ঠোটে রাখি, মেধায় রাখি না। বরং অতি চতুর অতি সপ্রতিভ প্রতীচ্য থেকে উড়ে-আসা ইতিহাস-সন্দর্ভ-ভাবাদর্শের মৃত্যু বিষয়ক ধারণার আঁধি আমাদের আচ্ছন্ন করছে। পক্ষাঘাতগ্রস্ত হাত দুটি তুলে এনে নিজের বুকের ওপর রেখে পরখ করতেও অনীহা, এখনো সেই পুরনো হৃৎপিণ্ড আগের তালে-লয়ে ধুকপুক করছে কিনা।
সব অস্থির এখন: আবেগ-চিন্তা-অনুভূতি-বিশ্বাস। ইচ্ছার ওপর সময়ের কর্তৃত্ব নিশ্চয়, কিন্তু ব্যক্তি কি নিরুপায় ভোক্তা ও গ্রহীতা! তাৎক্ষণিক তাগিদে যদি সব কিছুই হয়, লেখার উপকরণ তাহলে কী হবে? তন্বয়ের পুরনো রীতি বাতিল হয়ে গিয়ে যদি অনন্বয়ের সঞ্চরমান অনুভূতিপুঞ্জ সর্বেসর্বা হয়ে থাকে, তাহলে ঘটমানতা বলে কিছুই থাকবে না। যদি এমন হয়, গল্পকার এবং ঔপন্যাসিক কোনো ধরনের যথাপ্রাপ্ত সম্পর্কে মাথা ঘামাবেন না আর। অবভাস কী তত্ত্ববস্তুই বা কী! দ্রুত বদলে-যাওয়া এবং বদলাতে-থাকা এ সময়ে দর্শনেরও মৃত্যু ঘোষণা তবে অবধারিত। কালঃ পচতি ইতি বার্তা।
২
বাংলার মূল ভূখণ্ডের বাইরে আমরা যারা বাংলা বলি, লিখি, ভাবি, তর্ক করি—যথাপ্রাপ্ত প্রান্তিক অবস্থানের বিষণ্ণতা, বিচ্ছিন্নতা, গ্রন্থিলতা কি আমাদের সাহিত্যবোধে দুরপনেয় ছাপ ফেলেনি? আমাদের সৃষ্টি ও নির্মাণ, মেধা ও সংবিদকে কি হঠাৎ কুয়াশা এসে আচ্ছন্ন করে না? ইংরেজি ও স্পেনীয় ভাষায় যারা কথা বলেন, তাদের ভাষাচেতনা ও সাহিত্যচেতনা অবস্থান অনুযায়ী ভিন্নভিন্ন। প্রতিটি পরিসরের স্বতন্ত্র মর্যাদা নিয়ে কিন্তু কেউ প্রশ্ন তোলে না। হায়, জেলায়-জেলায় পরগণায়-পরগণায় যে বাংলা ভাষার রূপতাত্ত্বিক ও ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈচিত্র্য অসামান্য—সেই ভাষায় যারা কথা বলেন, তাদের বাঙালিত্ব এখনো প্রমাণ-সাপেক্ষ। দেবীপ্রসাদ সিংহ, শেখর দাশ, দুলাল ঘোষদের সৃষ্টির ভুবন সম্পর্কে কোনো কৌতূহল উত্তর-পূর্ব ভারতের বাইরে আছে কি? সূর্য যেমন পাহাড়ে ও সমতলে, সমুদ্রে ও অরণ্যে সমান রোদ্র ছড়িয়ে দেয়—সময়ও তেমনি একই উত্তাপ নিয়ে আসে। কে কতখানি শুষে নিচ্ছে, তা নির্ভর