পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১৪১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

স্থবিরতর হয়ে যাচ্ছে যত, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আস্তিক্যবাদের সাড়ম্বর বিজ্ঞাপন। এখানেই নাস্তিকের স্পর্ধিত উপস্থিতি অত্যন্ত জরুরি হয়ে উঠেছে। এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থায় উচ্চপ্রযুক্তির ডানা মেলে দিয়ে যখন শিকারী বাজপাখির মতো নেমে আসছে শূন্যগর্ভ আস্তিক্যবাদ, অতীতমুগ্ধ মিথ্যা বিশ্বাসেরা—সে-সময় আলো ও আলেয়ার মধ্যে তফাতটুকু বুঝিয়ে দেওয়ার জন্যে নাস্তিকতার সামাজিক প্রেরণায় নির্ভর করতে হবে। হয়তো বা কেউ বলতে পারেন, সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েট রাশিয়ায় তো আস্তিক্যবাদকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়নি। কিন্তু শেষপর্যন্ত, মানুষের সহজাত আস্তিকতার জয়ই তো হল! তাহলে?

 বরং উল্টো দিক থেকে কথাটা বলা যাক। বিশ্বপুঁজিবাদের গোপন ও দীর্ঘমেয়াদি চক্রান্তে প্রতিক্রিয়াবাদের সবচেয়ে বড়ো সহায়ক এবং প্রগতির সবচেয়ে কঠিন শত্রু বলেই তো প্রমাণিত হল আস্তিক্যের সংস্কার। সোভিয়েট রাশিয়ায় নতুন সমাজতান্ত্রিক মানুষ গড়ে তোলার জন্যে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল নিরবচ্ছিন্ন পুনর্নির্মাণের। ওই প্রক্রিয়ার মূল ভিত্তি নাস্তিকতার দার্শনিক ও সামাজিক প্রেরণা। কিন্তু রাষ্ট্রের কর্ণধারেরা এই অত্যন্ত জরুরি কাজটি করেননি, তার ওপর বিশ্বপুঁজিবাদের চতুর অন্তর্ঘাত। তাহলে আস্তিক্যবাদকে ব্যবহার করেই সমাজতন্ত্রে মানবমুক্তির সম্ভাবনাকে পর্যন্ত নাকচ করে দিতে পারল গণশত্রুর আন্তর্জাতিক সংঘ। এতে বরং নাস্তিকতা ও মানবচেতনার সার্বিক শৃঙ্খল মোচনের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কই প্রমাণিত হচ্ছে। প্রমাণিত হচ্ছে, যুক্তিবাদের কষ্টিপাথরে যাচাই করে নিতে হবে নিয়ত মানবমুখী নাস্তিকতাকেও। বহু ঘটনার আবর্তে বিভ্রান্ত বিশ শতকে এক পা এগিয়ে মানুষ বুঝি বা দুপা পিছিয়ে গেছে বারবার। এমনকী, মৌল মানবতা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে বীভৎস জান্তব অবয়বও দেখিয়েছে কখনো কখনো। তবু এ তো কবির বাচন নয় কেবল: মেঘ ক্ষণিকের, চিরদিবসের সূর্য। সংঘবদ্ধ মূঢ়তার কাছে নিশ্চয় আত্মসমর্পণ করবে না মানুষ। আমার পিতৃপুরুষের তৈরি কুয়ো—এই পরিত্যক্ত কুয়োর দূষিত জল পান করে কেউ?’—বিখ্যাত এই প্রশ্ন উচ্চারিত হয়েছিল বহুপঠিত সংস্কৃত শ্লোকে। উত্তরও দিয়েছিলেন ওই শ্লোককার, যে করে, সে কাপুরুষ!’ অর্থাৎ অবিবেচক ও অন্ধ। আস্তিক্যবাদের আড়ম্বর দিয়ে নিজেদের অন্ধতা যারা ঢেকে রেখেছে বহু শতাব্দি ধরে, তাদের দেখানো পথ ধরে চলতে গিয়ে নিজেদের অন্ধতর বলে প্রমাণিত করব কি? বাস্তব জীবনের কাল্পনিক বিশ্লেষণ কাম্য নাকি বাস্তবের বাস্তব বিশ্লেষণ চাই? যুক্তিবাদের কঠিন মাটিতে দাঁড়িয়ে যদি প্রত্যাখ্যান না করি মানবাতিরিক্ত সব কল্প-উপাদানকে, তাহলে তো নিজেদের যুক্তিকে নিজেরাই রোধ করে রাখব চিরকাল!

 তাই এ কেবল আস্তিক-নাস্তিকের প্রশ্ন নয়, এ আসলে জীবন আর মৃত্যু, আত্ম-প্রতিষ্ঠা আর আত্মবিলোপের মধ্যে যে-কোনো একটিকে বেছে নেওয়ারই প্রশ্ন। এখনো তো গেল না আঁধার! এখনো তো আস্তিক্যবাদের সূত্রে মানুষে-মানুষে বর্গ-বর্ণ-লিঙ্গগত বিভাজন সামাজিক প্রতাপের আস্ফালনকে পুষ্ট করছে। এখনো তো স্ববিরোধিতার সমাবেশ দেখেও যুক্তিহীন বিশ্বাসের দোহাই দিয়ে সব মেনে নিচ্ছি। এখনো তো

১৩৭