পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

করে বেশ কিছু প্রাকশর্তের ওপর। সময়ের নতুন সমিধকে কতখানি কীভাবে কারা কাজে লাগাচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করে আগুন ও ধোঁয়ার অনুপাত।

 এ সময় আগুনের, এসময় ধোঁয়ারও। রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক অন্তঃস্বরে তার অভ্রান্ত প্রমাণ নিহিত। শুধু দেখার চোখ চাই। পাঠকৃতির অন্তর্বর্তী অন্ধবিন্দুগুলি শনাক্ত করতে হবে, শূন্যায়তনগুলিরও নিবিড় পাঠ করা চাই। কেননা কথিত বাচনে শুধু সময় ধরা পড়ে না; বরং অকথিত পরাবাচনে সময়ের ইশারাগুলি থাকে। শব্দান্তবর্তী সেইসব শূন্যতা নিয়েই সম্পূর্ণ হয় চিহ্নায়কের গ্রন্থনা। কবিতা পড়ি কিংবা ছোটগল্প অথবা উপন্যাস, এমন কী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিসরের সমস্যা নিয়েই ভাবি, আমাদের বিশ্লেষণ হোক দ্বি-বাচনিকতায় আধারিত; ব্যক্তিসত্তা ও সামাজিক; সত্তার সুড়ঙ্গলালিত সম্পর্ক মাঝে মাঝে আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। ওই সম্পর্ক বিচারের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সময়কে বুঝি বিম্বিত পরিসরে, পরিসরকেও বুঝি সময়ের নিরিখে। এদের আন্তঃসম্পর্কে জটিলতা চিরকাল ছিল, চিরকাল থাকবে। যুগে যুগে তার পুনর্নবীকরণের ধরনটুকু পাল্টায় শুধু।

 আমাদের লেখায় বড়ো নির্জনতা এখন। হয়তো এই নির্জনতায় বিষাদ নেই তত। আছে উদ্ভট মান্যতার বোেধ; মান্যতা বলব, বৈধতা নয়। এখন আমরা প্রাজ্ঞ হতে পারি সহজে। তাই আমাদের ইদানীংকার পাঠকৃতিতে দেখতে পাই—সমস্ত কেমন যেন আপাত, ত্রিশঙ্কু, চূড়ান্তবিন্দু থেকে স্থিরীকৃত দূরত্বে রুদ্ধ। নিশ্চয় এই বোধও সময়-শাসিত। কিন্তু কীভাবে অস্বীকার করি যে আজকের লেখকেরা এবং আলোচকেরা সিদ্ধান্ত এড়িয়ে যাওয়াতে পারদর্শী? গভীর গভীরতর কোনো কারণে, সম্ভবত বিশ্বায়নের ছলে সংক্রামিত নির্মানবায়নের প্রভাবে, আমাদের সমস্ত বোধই অসাড় আজ। দাতা যেখানে, গ্রহীতাও সেখানে। ভুল প্রমাণিত হতে বড়ো ভয়। প্রতিটি পাঠকৃতি যে-ধরনের প্রত্যাশা জাগিয়ে শুরু হয়, আপাত-সমাপ্তির বিন্দুতে পৌছে দেখি, প্রত্যাশাকে কৌশলে পাশ কাটিয়ে গেছে বৌদ্ধিক চাতুর্য। ব্যতিক্রম আছে, কিন্তু তা তো নিয়মকেই প্রমাণিত করে।

 তাহলে কি জাঁ বদ্রিলারের বিষাদ-মথিত উচ্চারণই মেনে নেব: ‘We are condemned to social coma, political coma, historical coma. We are condemned to an anaesthetized disappearance, to a fading away under anasesthesia.' (তদেব: ৫)। এ সময়ের কবি ও কথাকারেরা, প্রাবন্ধিক ও সাংস্কৃতিক যোদ্ধারা এই বাচনের যথার্থতা খুঁজুন তাদের সৃষ্টি ও জীবনের যুগলবন্দি পাঠকৃতিতে। কিংবা প্রতিশ্ন করুন। বাঙালির সমস্ত ভুবনে অব্যাহত থাকুক এই খোজা বা প্রতিপ্রশ্ন হয়তো পরিসর অনুযায়ী মীমাংসা ভিন্ন হবে, হয়তো কোনো মীমাংসাই হবে না, তবু।