পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৫৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ঐতিহাসিকভাবে কিন্তু বৃহত্তর বঙ্গভূমিরই অংশ। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় এই ভূমিও মমতা-বিহীন কালস্রোতে বাংলার রাষ্ট্রসীমা হতে নির্বাসিত। বহু শতাব্দী থেকে বাঙালিদের নিরন্তর প্রব্রজন চলেছে এখানে, বাংলাই এখানকার ভাষা—কী সাহিত্যে কী গণসংযোগের মাধ্যম হিসেবে। ইতিহাসের বিচিত্র জটিলতায় তা আসামের অঙ্গ হলেও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার সঙ্গে এর কোনো আত্মিক সংযোগ কখনও ছিল না।

 দেশ বিভাজনের পরে রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় সর্বস্ব হারিয়ে পূর্ব পাকিস্তান থেকে লক্ষ লক্ষ বাঙালি এলেন বরাক উপত্যকায়। তাঁরা কয়েক প্রজন্মের ভিটে-মাটি থেকে উৎখাত হয়েছিলেন; কিন্তু নতুন করে ভাষার অভিজ্ঞান হারাতে রাজি ছিলেন না। তাঁরা সবাই উপভাষা অঞ্চলে প্রচলিত বিভিন্ন ধরনের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতেন, এখনো বলেন। কিন্তু দেশ বিভাজনের আগে যেহেতু তাদের বাঙালিত্ব বা কথ্যভাষার স্বরূপ সম্পর্কে কখনো কোনো প্রশ্ন ওঠেনি, তেমনি বাস্তুহারা হয়ে বরাক উপত্যকায় আসার পরে নতুনভাবে প্রশ্ন ওঠার কোনো কারণ ছিল না। আসামের পশ্চিম-প্রান্তিক জেলা গোয়ালপাড়াকে অসমিয়াকরণ নীতির সহজলভ্য শিকারে পরিণত করার পরে কাছাড় সম্পর্কেও একই নীতি গ্রহণ করা হয়। কিন্তু ভাষিক সম্প্রসারণবাদীদের চক্রান্ত যখন কাছাড়ে প্রতিহত হল, অসম সাহিত্যসভার মতো উগ্র আগ্রাসনপন্থী সংস্থা ও সরকারি আমলাতন্ত্র কাছাড়ের বাঙালিদের ভাষাকে বাংলা নয় বলে প্রমাণ করতে উঠে-পড়ে লাগল। জনগোষ্ঠীর যেসব অংশ শিক্ষার অভাবে পশ্চাৎপর, ভীরু ও লোভী হয়ে উঠেছিল, তাদের নানাভাবে কাজে লাগিয়ে আঞ্চলিক প্রভুত্ববাদীরা দিনকে রাত ও রাতকে দিন করতে চাইল। উপভাষা ও বিভাষার বৈচিত্রকে অসমিয়ার অপভ্রংশ বলে প্রমাণ করার জন্যে সরকারি পণ্ডিতেরা ‘থিসিস’ লিখলেন নানারকম। তাই বরাক উপত্যকার ভাষাসংগ্রামের অনেকগুলি দিক রয়েছে। এখানকার বাঙালিকে তার নিজস্ব জাতিসত্তা ও ভাষিক পরিচয়কে প্রমাণ করতে হচ্ছে তত্ত্ব ও তথ্য দিয়ে। বাংলাদেশে তা অন্তত করতে হয় না। আসলে মূর্খ যখন ধূর্ত ও কুচক্রী হয়ে ওঠে, তাদের সঙ্ঘবদ্ধ ষড়যন্ত্র প্রতিহত করার জন্যে সর্বদা সতর্ক থাকতে হয়। তাই ভাষা-সংগ্রাম নিয়ত নবায়মান সংকটের দিকেও তর্জনি সংকেত করে। বুঝিয়ে দেয়, এই সংগ্রাম নিরবচ্ছিন্ন ভাবে চলমান এবং স্তর থেকে স্তরাত্তরে আক্রমণ মোকাবিলা করার ধরনও আলাদা-আলাদা।

 এই প্রেক্ষাপট বুঝে নেওয়াটা খুব জরুরি। নইলে, ‘আসামে অসমীয়া ভাষা চলবে না তো কি তামিল, তেলেগু চলবে’ গোছের ফাঁপা সপ্রতিভতা দেখানোর রেওয়াজ চলতে থাকবে। সবচেয়ে পরিতাপের কথা, বাঙালিরাই তাঁদের অনেক ভুবন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন; এমন কী, দূরীকৃত অপর পরিসরগুলি সম্বন্ধে প্রায় নিষ্ঠুরভাবে উদাসীন। এইজন্যে ১৯ মে-র তাৎপর্য অনুধাবন করা সমস্ত বঙ্গভাষীর পক্ষে আবশ্যিক। নিছক কোনও দিবস উদ্‌যাপনের জন্যে নয়, জাতিসত্তা ও ভাষাসত্তার বহুস্বরিক নিষ্কর্ষ পুনঃপাঠ করার জন্যে ১৯ শের চেতনা হয়ে উঠতে পারে দর্পণের মতো। শাসকের তৈরি কৃত্রিম রাজনৈতিক মানচিত্র বাঙালির ভুবনকে বহুধা-বিচ্ছিন্ন করলেও সামূহিক

৫৪