পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৬৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

এপার বাংলা ওপার বাংলা
মধ্যে জলধি নদী
নির্বাসিতা নদীর বুকে
বাংলায় গান বাঁধি।

 আরো একবার ফিরে যাই দিলীপ লস্করের কবিতায়। আত্মগাথা’ নামক বয়ানের প্রথম নটি পঙক্তি এরকম:

‘যে নদীর পারে আমার ঘর
তার নাম কুশিয়ারা।
আমরা আখকে কুশিয়ার বলি,
ভাষাটা বরাকী নয়, বাংলা উপভাষা
আমরা কথা বলি মাত্রাবৃত্তে, সমিল পয়ারে,
পয়ারকে ডিটান বলি
ডিটানে ডিটানে শ্রুতিকাব্য গড়ে ওঠে’

 এত সব সত্ত্বেও মৌলিক এই প্রশ্ন বারবার উচ্চারিত হয় বরাক উপত্যকায় এবং বাইরে: বাংলা সাহিত্যের সর্বজনমান্য মানদণ্ড অনুযায়ী এখানকার কজন লিখিয়ে মর্যাদার দাবিদার হতে পেরেছেন? সাহিত্য-কেন্দ্রের সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় থাকার সুবাদে অবরে-সবরে দুচারটে নাম উচ্চারিত হওয়াকে কি মর্যাদা’ বলব! সামন্তপ্রভুরা মাঝে-মাঝে নিজেদের দূরের জায়গিরে গিয়ে, পরিতৃপ্তির মাশুল হিসেবে, সেইসব নাম নিয়ে আসবেন: এই কি ‘পরিচয়’ এর ব্যাকরণ? তবু বলব ‘সাহিত্যের নামে কলকাতার রঙমহলে পাসপোর্ট-ভিসা যোগাড় করছে কেউ কেউ’,—এই ভাবনা নিতান্ত ন্যক্কারজনক। কেননা লেখার শক্তিতে, দীর্ঘমেয়াদি অধ্যবসায়ের জোরে, বরাক উপত্যকার কোনো কোনো কবি ও গল্পকার বৃহত্তর বাংলা সাহিত্যের আঙিনায় নিজেদের উপস্থিতি ঘোষণা করতে পেরেছেন। শক্তিপদ ব্রহ্মচারী, বিজিৎকুমার ভট্টাচার্য, শঙ্করজ্যোতি দেব, বিজয়কুমার ভট্টাচার্য, মনোতোষ চক্রবর্তী, স্বর্ণালি বিশ্বাস, দেবাশিস তরফদার কবি হিসেবে বিভিন্ন অঞ্চলের বাঙালি পাঠকদের কাছে কম-বেশি পরিচিত এখন। তবে ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্যে যে-লড়াইতা আংশিক সময়ের লিখনকর্মীদের পক্ষে অব্যাহত রাখা অসম্ভব। মিথিলেশ ভট্টাচার্য, রণবীর পুরকায়স্থ, শেখর দাশ, বদরুজ্জামান চৌধুরী, সুব্রত কুমার রায়, মলয়কান্তি দে—গল্পকার হিসেবে নিজেদের চেনাতে পেরেছেন। তবে যেহেতু এঁরা কেউই সব-সময়ের লিখনযোদ্ধা নন, তিনজন ছাড়া অন্য কারও গল্পসংকলনও নেই—এদের কণ্ঠস্বর বৃহত্তর বাংলা সাহিত্যে তেমনভাবে পৌছায় না। ‘একটু উঠে একটু নেমে আমার কাছে দাঁড়াতে হয়’—কবির বাচন হিসেবে চমৎকার; কিন্তু রচয়িতা-গ্রহীতার মধ্যে কে কেন উঠবে বা নামবে, এর মীমাংসা সহজ নয়। দূরতম ‘মফঃস্বল’ এর বাঙালি কবি-লেখক বলে শক্তিপদ-বিজিৎ-অমিতাভ কিংবা রণবীর-শেখর-সুব্রত নির্বাসিত ভূখণ্ড থেকে ছুটে ছুটে যাবেন চোখ-ধাঁধানোে মন-মজাননা প্রতিষ্ঠাকেন্দ্রের দিকে: এটা হতেই পারে না। অতিসরলীকরণের এই পাটিগণিত এখন পুরোপুরি অচল।

৬৪