পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৭৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

চতুরতা যার শেষ কোথায় তা বলা কঠিন। রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা সংস্কৃতির সত্যকে আচ্ছন্ন করে বলেই তো সংকট ক্রমশ জটিল থেকে জটিলতর হয়ে ওঠে। অন্যদিকে যা ছিল মূলত বৌদ্ধিক বিচারের বিষয়, উপভাষাতত্ত্ববিদ ভাষা-বিজ্ঞানীর গভীর বিশ্লেষণে যার সমাধান হতে পারত-জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির কুটিল চক্রান্তে তা-ই পর্যবসিত হল বাংলার অঙ্গচ্ছেদ ঘটানোর দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়ায়। নিজবাসভূমে পরবাসী হওয়ার তীব্র গ্লানিময় অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাদের কোনওদিন যেতে হয়নি, তারাই ইদানীং আগুন নিয়ে খেলছেন। বুঝতে পারছেন না যে, এতে অচিরেই নিজের নাক-কান খোয়াতে হতে পারে এবং পরিণামে আবহমান বাংলার যাত্রাভঙ্গও ঘটে যাবে। কোনও সন্দেহ নেই যে বিশ শতকে ধাপে ধাপে বাঙালি জাতিগত ভাবে নিজেদের জন্যে দুরূহতম সংকটের বলয় রচনা করেছে। সেদিকে নজর দিয়ে আমরা নতুনভাবে সামূহিক পুনর্নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু করতে পারতাম। আমাদের স্বাতন্ত্র ও অনন্যতার কারণ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে প্রচ্ছন্ন রয়েছে। সেইসব অনুশীলনের প্রয়োজন ছিল খুব। কিন্তু তা আমরা করছি না। ঔপনিবেশিক চক্রান্তে বাংলার রাষ্ট্র-সীমা হতে নির্বাসিত শ্রীভূমির সংলগ্ন বরাক উপত্যকার অধিবাসী হিসেবে কোনও কোনও বাঙালি রয়েছেন বিচিত্র অবস্থানে। যেন ‘ঘরেও নহে পারেও নহে যে জন আছে মাঝখানে জাতীয় পরিসরে থাকার ফলে ঔপভাষিক অঞ্চলের অধিবাসীদের বারবার নিজেদের অনস্বীকার্য বাঙালিত্ব সম্পর্কে প্রমাণ দাখিল করতে হয়। শুধু অসহিষ্ণু ও পীড়নপ্রবণ সরকারের কাছে নয়, নিজের মাতৃভাষার অন্য শরিকদের কাছেও। এই গ্লানির অসহনীয়তা মান্য চলিত-ভাষী সংস্কৃতি-কেন্দ্র সংলগ্ন জনেরা কোনও দিন বুঝতে চান না। তবু এটাও মূল সমস্যার তুলনায় গৌন। বরং যে-তীব্র সংকট বাঙালি জাতির ভবিষ্যৎকেই বড় প্রশ্ন-চিহ্নের মুখখামুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, সে-বিষয়ে এখনই মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। খণ্ডিত হোক বা সীমাবদ্ধ, উনিশ শতকে বাঙালি জীবনে যে রেনেসাঁস এসেছিল আর সেই সূত্রে দেখা গিয়েছিল দীপায়ন ও যুক্তিবাদ, শতাব্দীর শেষ দুটি দশকে সেইসব স্তিমিত হয়ে প্রকট হয়ে উঠেছিল হিন্দু পুনরুত্থানবাদ। বিশ শতকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে নানা ধরনের উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতি সহস্র ধারায় বিকশিত হল ঠিকই; কিন্তু দ্বিজাতিতত্ত্বের পটভূমিও দৃঢ়তর হল। এর অনিবার্য প্রতিক্রিয়ায় প্রতীচ্যের শিক্ষা-ব্যবস্থায় ও মূল্যবোধে দীক্ষিত বাঙালি লেখাপড়া করেও কেবল হিন্দু বাঙালি বা মুসলমান বাঙালি হল। শুধু বাঙালি’ পরিচয়ে দাড়ানোর জন্যে যে ধর্ম-নিরপেক্ষ চেতনাকে ব্যক্তিগত ও সামাজিক স্তরে কর্ষণ করা দরকার ছিল, তা করা হল না। বীভৎস দাঙ্গার পরিবেশ তৈরি করে বাঙালি নিজের মাতৃভূমিকে দ্বিখণ্ডিত হতে দিল এবং হিন্দুত্ব ও মুসলমানত্বকে বরণ করে নিল। ১৯৫২ সালে কেউ কেউ ভুল শোধরানোর পালা শুরু করলেন যা ১৯৭১-এ যৌক্তিক পূর্ণতা পেল। কিন্তু মৌলবাদের শেকড় না উপড়ানোর ফলে বাঙালিত্ব-বিরোধী অপশক্তি ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠল। বিশ শতক পেরিয়ে যখন একুশ শতকে এলাম, দেখা গেল, পূর্বপাকিস্তানের

৭৩