পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৭৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বা তার থেকে জন্ম-নেওয়া বাংলাদেশে ইতিহাস যেন উল্টোপাকে ঘুরতে শুরু করেছে।

 ভুল ইতিহাস যখন রচিত হতে থাকে, সমাজ-প্রযুক্তির বিধি অনুযায়ী তাতে হস্তক্ষেপ করতে হয়। ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ হয়ে নব্বই এর দশকে পৌছাতে পৌছাতে সংস্কৃতি-সেনানী ও বুদ্ধিজীবীরা বারবার তেমন হস্তক্ষেপ করেছেন। ইতিহাসের বিপ্রতীপ গতি তারা মেনে নেননি। কিন্তু অতি সম্প্রতিকালে সমাজ-সংবিদ থেকে উঠে-আসা কোনও ইতিবাচক সামূহিক প্রতিক্রিয়া যেন দেখা যাচ্ছে না। সময়-মন্থনের প্রক্রিয়াও কি স্তব্ধ হয়ে গেল তবে? বিশ্বব্যাপ্ত মৌলবাদ যে এককেন্দ্রিক নয়া উপনিবেশবাদের প্রশ্রয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, বাঙালিত্ব কি বাংলাদেশে তার কাছে। সাময়িকভাবে হলেও হার মেনেছে? এ তো গেল বাংলা ভাষাভাষীদের একটা বড় তরফের সংকট। অন্য বড় তরফের সমস্যা তৈরি হয়েছে এইজন্যে যে তাদের সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক বীক্ষায় নিঃশব্দে একটা সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ঘটে গেছে। বিনা প্রশ্নে সর্বজনীন মান্যতা পেয়ে গেছে সাহিত্যের ইতিহাস সম্পর্কিত এই পরাপাঠ যে তা মূলত হিন্দু বাঙালির সাহিত্য। এইজন্যে ইউসুফ জুলেখাই হোক বা মীর মশারফ হোসেন ও কায়কোবাদ কিংবা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াস—পশ্চিমবঙ্গে রচিত সাহিত্যের ইতিহাসে এদের জন্যে বরাদ্দ হয় নামমাত্র পরিসর। আসলে সচেতনভাবে বাঙালিকে খুঁজলেও অবচেতন ভাবে হিন্দু বাঙালি কিম্বা মুসলমান বাঙালিদের খোঁজা হয়। সত্যি কথা বলতে কী, খোঁজা হয় শুধু মুসলমান কেননা মুসলমান ও বাঙালি—এই দুটি শব্দকে পাশাপাশি ব্যবহার করার রেওয়াজ এই সেদিন পর্যন্ত ছিল না। নইলে কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র কি লিখতেন বাঙালিদের সঙ্গে মুসলমানদের ফুটবল খেলার কথা?

 মুশকিল এখানেই যে বাঙালি তার নিজস্ব সমৃদ্ধ লোকায়ত ঐতিহ্যকে মর্যাদা দিতে শেখেনি। শিষ্টজনদের সাহিত্য-সংস্কৃতিতে লোকজীবন তো কৃষ্ণ মহাদেশ! এত বিশাল-সমান্তরাল পরিসর সম্পর্কে নামমাত্র কৌতূহল ছিল বলে সৃষ্টি ও নির্মিতিতে এক ধরনের কূপমণ্ডুকতা ও একবাচনিকতা অনিবার্য হয়ে পড়েছে। অথচ সেখানেই ছিল হিন্দু-মুসলমানদের পক্ষে নির্দ্বিধায় পরস্পরের শরিক হওয়ার সুযোগ। শেকড়ে জলের সহযোগ ছিল না বলেই হয়তো মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতিপূরণের তাগিদে কল্পিত আকাশের কৃত্রিম নির্মাণ দেখা গেল। ঔপনিবেশিক আধুনিকতার মোহে এই প্রক্রিয়ার অন্তর্বর্তী সাংস্কৃতিক রাজনীতির প্রতি মনোযোগী হলেন না কেউ। হিন্দু বাঙালি আর্য-মহিমায় নিষ্ণাত হয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে চাইল; রাজপুত ও মারাঠা বীরদের গৌরব-কাহিনি প্রচার করে সমকালীন গ্লানি থেকে মুক্তির পথ খুঁজে নিল। ফলে বাঙালিত্ব নয়, হিন্দুত্ব হল তার স্বাজাত্যবোধের ভিত্তি। স্বভাবত নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ে যারা নিকট আত্মীয়, সেই মুসলমানদের ভাবতে শিখল বিজাতীয় শত্রু বলে। অন্যদিকে মুসলমান বাঙালি যে কয়েক পুরুষ আগে বর্ণাশ্রম প্রথার পীড়নে কিংবা রাজধর্ম গ্রহণ করে বৈষয়িক সমৃদ্ধি অর্জনের স্বার্থে ধর্মান্তরিত হয়েছে—এই তথ্য ভুলে গিয়ে সুদূর

৭৪