পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৮০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

স্বতঃস্ফূর্ত। চৈতন্য থেকে লালন পর্যন্ত যে-ধারা প্রবহমান, তাতে বাঙালিত্বের আধার ও আধেয়কে বিশ্বমানবিক চেতনায় উত্তীর্ণ করা হয়েছে। ভারতীয়ত্বের ধারণায় বাঙালি যে অভূতপূর্ব বস্তুগত ও চিন্তাগত উপাদান সরবরাহ করেছে, সেই ইতিহাস অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু নির্মোহ দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করলে বুঝব, এর রাজনৈতিক অন্তর্বস্তু যতটা প্রকট, সাংস্কৃতিক অন্তর্বস্তু ততটা নয়। ভারতীয় সংস্কৃতির বোধকে ক্রমাগত চেষ্টায় নির্মাণ করতে গিয়ে বারবার উদ্ধত প্রতাপের কবলে পড়তে হয়েছে। অথচ এই গুরুতর বিষয়টি নিয়ে কেউ কখনও আন্তরিক বিশ্লেষণ করেননি। এতে সবচেয়ে বিপদ যাদের হয়েছে, সেইসব ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন বাঙালিদের কথা আগে লিখেছি। এবার আরও একটু স্পষ্ট করে লিখতে চাই, আসাম-ত্রিপুরা-মেঘালয়- বিহার-উড়িষ্যাউত্তরপ্রদেশ সহ ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসকারী সেইসব বাঙালিদের কথা। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ভাষা ধার করে বলা যায়—এদের ঘর নেই—আছে তাবু অন্তরে বাহিরে। এদের জন্যে নির্দিষ্ট কোনও মানচিত্র নেই। তাই এরা কেবল সমাজতত্ত্ববিদদের অন্তর্দেশীয় প্রব্রজনের বিষয়।

 এঁদের জন্যে বাঙালিত্ব অটুট রাখার কোনও পথ খোলা নেই। আসামের লোক-গণনায় স্থানীয় রাজনীতির চাপে একদল বাঙালিকে বলতে হয় আমাগো ভাষা অহইম্যা’, অন্যদের ক্ষেত্রে কোনও জিজ্ঞাসাবাদের তোয়াক্কা না করে তাদের লেখানো হয় নব অসমীয়া’ বলে। সর্বশেষ আদমসুমারিতে মোল্লাতন্ত্রের এক দাপুটে রাজনৈতিক প্রতিনিধি আসামের অভিবাসী মুসলমানদের পরামর্শ দিয়েছে, মাতৃভাষা বাংলা ছেড়ে দাও—অসমিয়া পরিচয় লেখাও। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের ধনপ্রাণ বিপন্ন হয়, হচ্ছে। বারেবারে। প্রশাসনিক সন্ত্রাসবাদ উগ্র চেহারা নিয়ে দেখা দেয় যখন, একাধিক প্রজন্ম ধরে আসামে বসবাসকারী বাঙালিদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়, হচ্ছে বিদেশি শনাক্তকরণের নোটিশ। কিংবা হালে বরপেটায় উগ্র অসমিয়া সম্প্রসারণবাদের ঠ্যাঙারে পুলিশবাহিনী। প্রসারী লক্ষ্যে গুলি করে মেরেছে অভিবাসী বাঙালি মুসলমানদের। এ আরেক অশনিসংকেত। বাসস্থানের, শিক্ষার ও জীবিকার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয় তাদের, আরও হবে একই অবস্থা মেঘালয়-মনিপুর-মিজোরাম-অরুণাচলনাগাল্যাণ্ডে। আসামে বাংলা ভাষার পাঠ্য বইতে সচতুরভাবে ভাষার শুদ্ধতায় অন্তর্ঘাত করা হয় অসমিয়া শব্দবন্ধ ও বাক্যগঠনরীতি ব্যবহার করে। উপনিবেশীকৃত মন নিয়ে প্রান্তিকায়িত বাঙালি এই বেপরোয়া বিদূষণকে মেনে নিতে বাধ্য হয়। ত্রিপুরায় উগ্রপন্থীদের আক্রমণের লক্ষ্য খেটে-খাওয়া ও ছাপোষা মধ্যবিত্ত বাঙালি। মেঘালয়েও তা-ই। সুতরাং বাঙালিদের সামনে দোঁ-আশলা অসমিয়ায় বা হিন্দি-ভাষীতে পরিণত হওয়া ছাড়া আর কী পথ আছে? বাঙালিত্বের কর্ষণ যখন বিপজ্জনক, হিন্দুত্ব বা মুসলমানত্বের পথই খোলা থাকে শুধু।

 বৈদ্যুতিন গণ-মাধ্যমের মধ্য দিয়ে হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান তত্ত্বের বৌদ্ধিক সন্ত্রাসে

৭৬