পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৮৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

প্রান্তিকায়িত নিম্নবর্গের ভাষাকে সাংস্কৃতিক রাজনীতিগত বাধ্যবাধকতায় সংশোধন করে নিতে সচেষ্ট হয়ে ওঠে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকে যদি নিম্নবর্গীয় চেতনার নিরিখে পুনঃপাঠ করি আজ, ভাষার সংগঠনে প্রতাপ ও অস্তেবাসীর দ্বন্দ্বের ইতিহাসও বুঝে নিতে পারব। নিঃসন্দেহে বিভিন্ন সময় আধিপত্যবাদের আগ্রাসী মনোভাব ভাষা-ব্যবহারকারীদের জন্যে বিপন্নতা তৈরি করেছে; কিন্তু সেই বিপন্নতার মোকাবিলা করেই এগিয়েছে বাংলা ভাষা। রণকৌশলগত কারণে কিছু কিছু পুরনো উপাদান বর্জন করতে হয়েছে, আবার কিছু কিছু নতুন প্রবণতা গ্রহণ করতে হয়েছে। যতদিন এই দ্বিবাচনিকতার অবকাশ থাকে, ততদিন ভাষা মরা নদীর সোঁতা হয় না। প্রাক্-ঔপনিবেশিক পর্যায়ে পারসিক উপকরণ বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধই করেছিল যদিও এইসব বিজাতীয় উপাদান মেনে নেওয়ার পেছনে সক্রিয় ছিল বৈষয়িক বুদ্ধি; ইসলাম ধর্মাবলম্বী শাসকদের কাছাকাছি যাওয়ার মনস্তাত্ত্বিক তাড়না।

 ঔপনিবেশিক পর্যায়ে ইংরেজদের সংস্পর্শে এসে মুৎসুদ্দি বর্গের পোয়াবারো হলেও তাদের নতু ভাষা-বিন্যাস অনিবার্য ভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল সমাজের অন্যান্য অংশে। বাংলা ভাষার গ্রহিষ্ণুতা তার ধারণক্ষমতাকে কতদূর অবধি বাড়াতে পেরেছিল, উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে বাংলা সাহিত্যের দুরন্ত গতিবৃদ্ধিতে তার প্রমাণ মেলে। প্রতীচ্য শিক্ষায় উদ্ভাসিত বৌদ্ধিক বর্গ যদিও প্রথম দিকে ইংরেজিকে বাংলার প্রতিপক্ষ হিসেবে হাজির করে মিথ্যা লড়াই লাগিয়ে দিয়েছিলেন, ক্রমশ মুষলের মতো ব্যবহার কমে গিয়ে তুলির মতো ব্যবহার শুরু হয়েছিল। এতে শেষ পর্যন্ত লাভবান হল বাংলা ভাষা। তখনও কয়েক দশকের জন্যে বিপন্নতার ঘূর্ণিবার্তা তৈরি হয়েছিল; কিন্তু ধুলো ও আঁধি একসময় সরে গেল। তেমনই রাজনীতির ধর্মীয়করণের ফলে দ্বিজাতিতত্ত্বের বিষবাষ্প যখন ছড়াতে শুরু করল, ইসলামি বাংলা নামক কাঠালের আমসত্ত্ব দিয়ে ভাষার অন্য আরেক ধরনের বিপন্নতা সূচিত হল। এর আগে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র, রাষ্ট্রতন্ত্র, উপনিবেশবাদ সংস্কৃত-পারসিক-ইংরেজি ভাষার প্রতাপমূলক উপস্থিতি দিয়ে যা করতে পারেনি, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ তাই করতে সমর্থ হল। একটু আগে যাকে আদি পাপ বলেছি, সেই দ্বিজাতিতত্ত্ব-ভিত্তিক দেশবিভাগ বাংলা ভাষায় কার্যত অতলান্ত বিপন্নতার সূচনা করেছে। চর্যাপদেরও আগে থেকে যে-ভাষার বহুরৈখিক যাত্রা শুরু হয়েছিল, এবার সেই ভাষার ব্যবহারকারীদের মধ্যে তৈরি হল সংশোধনাতীত বিচ্ছেদের প্রাচীর।

 ‘সংশোধনাতীত’ বলছি এইজন্যে যে বাঙালি আর নিজেকে একই জাতি-গোষ্ঠীর আবেগ-সিঞ্চিত অনুভূতি-নিবিড় অবস্থানে দেখতে পাচ্ছে না। সহস্রাধিক বছরের চলমান ঐতিহ্যবোধে হস্তক্ষেপ করল ধর্ম। হিন্দুস্তান আর পাকিস্তান—এই দুটি অভিজ্ঞানে কোথাও কাহ্নপা নেই, চণ্ডীদাস নেই, মধুসূদন নেই, জীবনানন্দ নেই, ওয়ালীউল্লাহ নেই, অবন ঠাকুর নেই, সুনীতি চাটুজ্জে নেই, শহীদুল্লাহ নেই। পাকিস্তানের পাঁজর থেকে বাংলাদেশ জন্ম নেওয়ার পরেও আদিপাপ ঘুচল না। হাসান আজিজুল হক-আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সত্ত্বেও নয়। নইলে একুশ শতকের গোড়ায় বাংলাদেশের মুখে আবারও পাকিস্তানি মুখোসের উকিঝুঁকি দেখতে পেতাম না। যতদিন বাঙালি হিন্দু

৮২