পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৮৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বাঙালি আর মুসলমান বাঙালি হয়ে থাকবে, শুধু বাঙালি হতে শিখবে না—ততদিন বাংলা ভাষার বিপন্নতা কাটবে না। প্রাগুক্ত ওই আদি-পাপ শুধু বাঙালির ভূমি, মনন ও হৃদয়কে দ্বিখণ্ডিত করেনি, তথাকথিত হিন্দুস্তানের বাঙালিদের বহুধা-বিচ্ছিন্ন করেছে। ছিন্নমূল বাঙালির প্রব্রজন শুরু হয়েছে ধিক্কার-গ্লানি-লাঞ্ছনা-অপমানের বিস্তারের মধ্য দিয়ে। পশ্চিম বাংলা পর্যন্ত টলোমলো, তার মানচিত্র যে-কোনো দিন বদলে যেতে পারে। বহু বাংলাভাষী পণ্ডিত এখন বাংলা ও বাঙালির ‘সংকীর্ণ’ পরিচয়ে বাঁচতে নারাজ। হিন্দুত্ববাদীরা (প্রচ্ছন্ন বা প্রকট) যে আর্যাবর্তের প্রভুত্ব কায়েম করতে চায়, এই সত্য আজ অন্ধের কাছেও স্পষ্ট। অথচ ওই পণ্ডিতেরা দেখেও দেখেন না, বুঝেও বোঝেন না যে আজকের ভারতবর্ষে শাসকশক্তি অভ্যন্তরীন উপনিবেশবাদের প্রতিনিধি।

 অত্যন্ত চতুরভাবে এই প্রভুত্ববাদী শক্তি সমস্ত ধরনের গণমাধ্যমকে কজায় নিয়ে সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদী প্রক্রিয়া চালু করেছে। বাংলা ভাষার ঘোর শত্রু এরা। কার্যত ঘোষিতভাবেই বহুধা-বিচ্ছিন্ন বাঙালির নিজস্ব ভূগোল নেই। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিদেশি খেদাও মানে বাঙালি খেদাও। আমাদের পণ্ডিতেরা এবিষয়ে এথনিসিটি’ ‘ডায়াসপোরা’ ‘সোস্যাল টেনশন ইত্যাদি লক্ষ্য করে আপ্লুত হন; কিন্তু কোদালকে সোজাসুজি কোদাল কখনো বলেন না। এঁদের বাঙালিত্ব যেহেতু বাস্তব জীবনে অপ্রতিষ্ঠিত (কেননা এঁদের ঘর নেই, আছে তবু অন্তরে বাহিরে), বাংলা ভাষার তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক পরিসরে দেখতে পাই অদ্ভুত অনিশ্চয়তা ও লক্ষ্যহীনতা। যখন বাংলা ভাষার বিপন্নতা নিয়ে ভাবি, নিজস্ব ভূগোলবিহীন এইসব বাঙালিদের বাচনিক অভিজ্ঞতাকে কি বাদ দেব প্রত্যাখ্যাত, অপ্রয়োজনীয় ও ফালতু ‘অপর পরিসর’ বলে? এঁদের দৈনন্দিন ব্যবহার এবং সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক প্রয়োগে কোনো ধরনের কৌনিকতা ও উচ্চাবচতা খুঁজব কিনা—এ সম্পর্কে স্পষ্ট বক্তব্য চাই। অথবা খণ্ডিত বাঙালি সত্তার ভাষা-ব্যবহার, তার সংকট ও সম্ভাবনা বা সম্ভাবনা-শূন্যতা নিয়ে বয়ান তৈরি করে ভাবতে হবে যে এটাই ব্যতিক্রমহীন সর্বজনীন সত্য। তবে বাংলা ভাষার প্রাণকেন্দ্র বলে কলকাতা মহানগরকে যদি ধরে নিই, সেখানে কি বয়ে চলেছে শুধুই সুপবন? প্রচুর বাংলা বই বেরোচ্ছে, ঢাউস পত্রিকা বিনোদন-পণ্য হয়ে নিয়মিত হাজিরা দিচ্ছে, লিটিল ম্যাগের টেবিলগুলিতে তুফান উঠছে। কোথাও কোনো সমস্যার ছায়া নেই, যথাপূর্ব তথাপরম্। বিপন্নতা কি তবে কেন্দ্রচ্যুত ও কেন্দ্রবহির্ভূত ভাষা-ব্যবহারকারীদের?

 লাগাতার কয়েক বছর কলকাতা বইমেলার দম-আটকানো ধুলো-ছিটোনো ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে মনে হয়েছে, এত লাখ-লাখ যদি ক্রেতা-পাঠক, তাহলে ছোট পত্রিকাগুলোর নুন আনতে পান্তা ফুরোয় কেন? কেন স্ট্যাণ্ড প্যাভিলিয়নে আর টেবিলে-টেবিলে অক্রেতা আড্ডাবাজদের ছেঁড়াখোঁড়া জমায়েত শুধু? ‘সারী, তুমি কার’? ‘ওগো বাংলা ভাষা, তুমি কার?’মনে আসে বিকের সেই মৃত্যুহীন এপিটাফের দুটিপঙক্তি: Rose oh the pure contradiction, delight!/Of being no ones sleep under so many lids.' মনে হয়, ইউরেকা, এই তো পেয়ে গেছি বাংলা ভাষারও চমৎকার লাগসই এপিটাফ। ‘প্রত্যেকের চোখের পাতায়, তবু কারও নিদ্রা নও তুমি!’ কারা যেন

৮৩