পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/১৪০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

লাথি, মারিয়াও দরজা খুলিল না। জানলাগুলি অনেক উঁচুতে, আর বাহির হইতে বন্ধ করা-চৌকিতে উঠিয়াও নাগাল পাওয়া গেল না। ভোলানাথের কপালে দরদর করিয়া ঘাম ঝরিতে লাগিল। সে ভাবিল প্রাণপণে চীৎকার করা যাক—যদি কেউ শুনতে পায়। কিন্তু তাহার গলার স্বর এমন বিকৃত শুনাইল আর মস্ত ঘরটাতে এমন অদ্ভুত প্রতিধ্বনি হইতে লাগিল, যে নিজের আওয়াজে নিজেই সে ভয় পাইয়া গেল। ওদিকে প্রায় সন্ধ্যা হইয়া আসিয়াছে। কলেজের বটগাছটির উপর হইতে একটা প্যাঁচা হঠাৎ ‘ভূত-ভূতুমভূত’ বলিয়া বিকটশব্দে ডাকিয়া উঠিল। সেই শব্দে একেবারে দাঁতে দাঁত লাগিয়া ভোলানাথ এক চীৎকারেই অজ্ঞান।

 কলেজের দরোয়ান তখন আমাদের ইস্কুলের পাঁড়েজি আর দু-চারটি দেশভাইয়ের সঙ্গে জুঠিয়া মহা উৎসাহে, ‘হাঁ হাঁ রে কাঁহা গয়ো রাম’ বলিয়া ঢোল করতাল পিটাইতে ছিল, কোনোরূপ চীৎকার শুনিতে পায় নাই। রাত-দুপুর পর্যন্ত তাহাদের কীর্তনের হল্লা চলিল। সুতরাং জ্ঞান হইবার পর ভোলানাথ যখন দরজায় দুম্‌দুম্ লাথি মারিয়া চেঁচাইতেছিল, তখন সে শব্দ গানের ফাঁকে ফাঁকে তাহাদের কানে একটু আধটু আসিলেও তাহারা গ্রাহ্য করে নাই। পাঁড়েজি একবার খালি বলিয়াছিল, কিসের শব্দ একবার খোঁজ লওয়া যাক—তখন অন্যেরা বাধা দিয়া বলিয়াছিল, “আরে, চিল্লানে দেও।” এমনি করিয়া রাত বারোটার সময় যখন তাহাদের উৎসাহ ঝিমাইয়া আসিল, তখন ভোলানাথের বাড়ির লোকেরা লণ্ঠন হাতে হাজির হইল। তাহারা বাড়ি-বাড়ি ঘুরিয়া কোথাও তাহাকে আর খুঁজিতে বাকি রাখে নাই। দরোয়ানদের জিজ্ঞাসা করায় তাহারা একবাক্যে বলিল, ‘ইস্কুলবাবুদের’ কাহাকেও তাহারা দেখে নাই। এমন সময় সেই দুম্‌দুম্ শব্দ আর চীৎকার আবার শোনা গেল।

 তার পর ভোলানাথের সন্ধান পাইতে আর বেশি দেরি হইল না! কিন্তু তখনো উদ্ধার নাই—দরজা বন্ধ, চাবি গোপালবাবুর কাছে, গোপালবাবু বাসায় নাই, ভাইঝির বিবাহে গিয়াছেন, সোমবার আসিবেন। তখন অগত্যা মই আনাইয়া, জানলা খুলিয়া, শার্শীর কাঁচ ভাঙিয়া, অনেক হাঙ্গামার পর ভয়ে মৃতপ্রায় ভোলানাথকে বাহির করা হইল। সে ওখানে কি করিতেছিল, কেন আসিয়াছিল, কেমন করিয়া আটকা পড়িল, ইত্যাদি জিজ্ঞাসা করিবার জন্য তাহার বাবা প্রকাণ্ড একচড় তুলিতেছিলেন, কিন্তু ভোলানাথের ফ্যাকাশে মুখখানা দেখিবার পর সে চড় আর তাহার গালে নামে নাই। নানাজনে জেরা করিয়া তাহার কাছে যে-সমস্ত কথা আদায় করিয়াছেন, তাহা শুনিয়াই আমরা তাহার আটকা পড়িবার বর্ণনাটা দিলাম। সে কিন্তু আমাদের কাছে এত কথা কবুল করে নাই। আমাদের সে আরো উলটা বুঝাইতে চাহিয়াছিল যে, সে ইচ্ছা করিয়াই বাহাদুরির জন্য কলেজবাড়িতে রাত কাটাইবার চেষ্টায় ছিল। যখন সে দেখিল যে তাহার সে কথা কেহ বিশ্বাস করে না, বরং আসল কথাটা ক্রমেই ফাঁস হইয়া পড়িতেছে, তখন সে এমন মুষড়াইয়া গেল যে অন্তত মাস তিনেকের জন্য তাহার সর্দারির অভ্যাসটা বেশ একটু দমিয়া পড়িয়াছিল।

সন্দেশ-চৈত্র, ১৩২৫
ইস্কুলের গল্প
১৩৭