পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/১৪৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বেলা দোষ হয় না, আমি দুটো কথা বেশি বললেই যত দোষ!” এও সহ্য করা যেত, কিন্তু শেষ দৃশ্যের সময় তার মোটেও আসবার কথা নয়, তা জেনেও সে স্টেজে আসবার জন্য জেদ ধরে বসল। আমরা অনেক কষ্টে, অনেক তোয়াজ করে, তাকে বুঝিয়ে দিলাম যে, শেষ দৃশ্যে দেবদূত আসতেই পারে না, কারণ তার আগের দৃশ্যেই আছে যে দেবদূত বিদায় নিয়ে স্বর্গে চলে গেলেন। শেষ দৃশ্যেও আছে যে মন্ত্রী রাজাকে সংবাদ দিচ্ছেন যে দেবদূত মহারাজকে আশীর্বাদ করে স্বর্গপুরী প্রস্থান করেছেন। দাশু অগত্যা তার জেদ ছাড়ল বটে, কিন্তু বেশ বোঝা গেল সে মনে মনে একটুও খুশি হয় নি।

 শেষ দৃশ্যের অভিনয় আরম্ভ হল। প্রথম খানিকটা অভিনয়ের পর মন্ত্রী এসে সভায় হাজির হলেন। এ কথা সে কথার পর তিনি রাজাকে সংবাদ দিলেন, “বারবার মহারাজে আশিস করিয়া, দেবদূত গেল চলি স্বর্গ অভিমুখে।” বলতেই হঠাৎ কোখেকে, “আবার সে এসেছে ফিরিয়া” বলে একগাল হাসতে হাসতে দাশু একেবারে সামনে এসে উপস্থিত। হঠাৎ এরকম বাধা পেয়ে মন্ত্রী তার বক্তৃতার খেই হারিয়ে ফেলল, আমরাও সকলে কিরকম যেন ঘাবড়িয়ে গেলাম—অভিনয় হঠাৎ বন্ধ হবার জোগাড় হয়ে এল। তাই দেখে দাশু খুব সর্দারি করে মন্ত্রীকে বলল, “বলে যাও কি বলিতেছিলে।” তাতে মন্ত্রী আরো কেমন ঘাবড়িয়ে গেল। রাখাল প্রতিহারী সেজেছিল, সে দাশুকে কি যেন বলবার জন্য যেই একটু এগিয়ে গেছে, অমনি দাশু, “চেয়েছিল জোর করে ঠেকাতে আমারে এই হতভাগা”-বলে এক চাটি মেরে তার মাথার পাগড়ি ফেলে দিল। ফেলে দিয়েই সে রাজার শেষ বক্তৃতাটা “এ রাজ্যেতে নাহি রবে হিংসা, অত্যাচার, নাহি রবে দারিদ্র্য যাতনা” ইত্যাদি—নিজেই গড়গড় করে বলে গিয়ে, “যাও সবে নিজ নিজ কাজে” বলে অভিনয় শেষ করে দিল। আমরা কি করব বুঝতে না পেরে সব বোকার মতো হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম। ওদিকে ঢং করে ঘণ্টা বেজে উঠল আর ঝুপ করে পর্দা নেমে গেল।

 আমরা সব রেগেমেগে লাল হয়ে দাশুকে তেড়ে ধরে বললাম, “হতভাগা, দেখ দেখি সব মাটি করলি, অর্ধেক কথা বলাই হল না।” দাশু বলল, “বা তোমরা কেউ কিছু বলছ না দেখেই তো আমি তাড়াতাড়ি যা মনে ছিল সেইগুলো বলে দিলাম। তা না হলে তো আরো সব মাটি হয়ে যেত।” আমি বললাম, “তুই কেন মাঝখানে এসে সব গোল বাধিয়ে দিলি? তাই তো সব ঘুলিয়ে গেল।” দাশু বলল, “রাখাল কেন বলেছিল যে আমায় জোর করে অটিকিয়ে রাখবে? তা ছাড়া তোমরা কেন আমায় গোড়া থেকে নিতে চাচ্ছিলে না আর ঠাট্টা করছিলে? আর রামপদ কেন বারবার আমার দিকে কট্‌মট্ করে তাকাচ্ছিল?” রামপদ বলল, “ওকে ধরে ঘা দু-চার লাগিয়ে দে।”

 দাশু বলল, “লাগাও না, দেখবে আমি এক্ষনি চেঁচিয়ে সকলকে হাজির করি কি না!”

সন্দেশ—আশ্বিন, ১৩২৯
১৪৪
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী : ২