পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/১৮৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

দেখিতে পাইবে, আর একবারটি যদি তাহাকে চিমিয়া রাখ তবে আর কোনোদিন ভুলিবে না।

 পৃথিবীর যেমন মানচিত্র বা 'ম্যাপ' হয়, আকাশেরও তেমনি মানচিত্র আছে। এইরকমের অনেক মানচিত্রে আকাশের তারার সঙ্গে অনেক অদ্ভুত ছবি আঁকা থাকে। তাহার মধ্যে যদি কালপুরুষ বা Orion-এর ছবি খুঁজিতে যাও, তবে হয়তো দেখিবে একটা হাত-পাসুদ্ধ মূর্তি আঁকা আছে কিন্তু আকাশে খুঁজিলে অবশ্য সেরকম কোনো চেহারা পাইবে না—দেখিবে কেবল ঐ তারাগুলি।

 আকাশের গায়ে যে এত হাজার হাজার তারা জড়ানো রহিয়াছে, মানুষ অতি প্রাচীন কাল হইতেই তাহার মধ্যে নানারকম ছবি ও মুর্তির কল্পনা করিয়া আসিতেছে। কতগুলা তারা মিলিয়া হয়তো অর্ধচন্দ্রের মতো দেখায়, মানুষে বলিল 'ওটা ধনুকের মতো' কোনোটা হয়তো মুকুট, কোনোটা ষাঁড়ের মাথা, কোনোটা ভল্লুক, কোনোটা যমজ ভাই, কোনোটা যোদ্ধা, এইরূপ নানারকম কল্পনার মুর্তিতে সমস্ত আকাশটিকে ঢাকিয়া দেওয়া হইয়াছে। অনেক সময়েই এ-সকল কল্পনাকে নিতান্তই আজগুবি বলিয়া মনে হয় কিন্তু এই কালপুরুষের বেলা বোধ হয় কল্পনাটা বেশ খাটিয়াছে। দুই হাত দুই পা আর মাথা সবই মিলিতেছে, তার উপর আবার কোমরবন্ধ। তলোয়ারটি পর্যন্ত বাদ যায় নাই। এত কথা যে বলিলাম সে কেবল ঐ তলোয়ারটির জন্য। ঐ তলোয়ারটার দিকে একবার ভালো করিয়া দেখ দেখি। তিনটি তারার মধ্যে মাঝেরটি একটু কেমন কেমন দেখায় না? আর সবগুলি তারা পরিষ্কার ঝকঝকে হীরার টুকরার মতো, কিন্তু এটা যেন কেমন একটু ঝাপসা ঠেকে। শুধু চোখে এই পর্যন্ত। কিন্তু দুরবীন দিয়া দেখ, আরো তফাত দেখিবে। যত বড়ই দুরবীন কষো-না কেন, আর সব তারাগুলিকে কেবলই ঝিকমিকে হীরার মতো দেখিবে কিন্তু এই তারাটিকে দেখিবে যেন সাদা মেঘের মতো। আকাশে এইরকম মেঘের মতো জিনিস আরো অনেক দেখা যায়—ইহাদের নাম নীহারিকা, ইংরাজিতে বলে Nebula।

 পণ্ডিতেরা বলেন, এই নীহারিকাগুলা এককালে তারা হইবে এবং এই তারাগুলাও এককালে নীহারিকা ছিল। আমরা যাহাকে সৌরজগত বলি—এই সূর্য এবং গ্রহ উপগ্রহসুদ্ধ তাহার বিশাল পরিবারটি—এই-সমস্তই এককালে কোনো এক প্রকাণ্ড নীহারিকার মধ্যে খিচুড়ি পাকাইয়া ছিল। সে যে কত বড়ো ব্যাপার তাহা কল্পনাও করা যায় না। সেই নীহারিকা আকাশের একটা প্রকাণ্ড কোণ জুড়িয়া জ্বলন্ত বাষ্পের মতো দপ্‌দপ্ করিয়া জ্বলিত। তাহার মধ্যে না ছিল চন্দ্র সূর্য, না ছিল পৃথিবী।

 ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে কাহারও স্থির হইয়া থাকিবার নিয়ম নাই, একটা কণাপ্রমাণ বস্তু আর একটি কণাকে পাইলে এ উহাকে টানিয়া লয়, দশটা কণা একত্র হইলেই পরস্পরের দিকে ছুটিয়া জমাট বাঁধিতে চায়। সুতরাং এত বড়ো নীহারিকাটি যে স্থির হইয়া থাকিবে, এমন কোনো উপায় ছিল না—সে আপনার ভিতরকার টানাটানির মধ্যে পড়িয়া ঘুরপাক খাইতে লাগিল আর তাহার মধ্যখানে প্রকাণ্ড একটা বাষ্পের ঢিপি জমাট হইতে লাগিল। এই জমাট ঢিপিকেই এখন আমরা সূর্য বলি।

১৭৮
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী : ২