পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/১৯১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

তখন বিনা প্রয়োজনেও রোগী ঐ-সকল ঔষধের জন্য পাগল হইয়া উঠে-এবং ঔষধের দাস হইয়া সমস্ত জীবনটিকে মাটি করিয়া ফেলে।

 ১৮০০ খৃস্টাব্দে অর্থাৎ একশো সতেরো বৎসর পূর্বে হাম্‌ফ্রে ডেভি নামে একজন অসাধারণ ইংরাজ পণ্ডিত একপ্রকার 'গ্যাস' লইয়া পরীক্ষা করিতেছিলেন। ইংরাজিতে ইহাকে 'Laughing Gas’ অর্থাৎ হাসাইবার গ্যাস বলা হয়। এই জিনিসটিকে নিশ্বাসের সঙ্গে টানিতে গেলে ঘাড়ে মাথায় কেমন সুড়্ সুড়্ করিতে থাকে—তাহাতে অনেকের হাসি আসে। ডেভি দেখিলেন, শুধু সুড়্ সুড়্ করে তাহা নয়, একটু বেশি করিয়া টানিলে মানুষ অজ্ঞান হইয়া পড়ে। এইরকমভাবে একটুখানি গ্যাস শুকাইয়া মানুষকে মিনিটখানেক বেশ আরামে বেহুঁশ করিয়া রাখা যায়। তাহাতে খুব দুর্বল লোকেরও কোনো অনিষ্ট হইতে দেখা যায় না। ডেভি বলিলেন, “এই উপায়ে বেশ সহজেই বিনা যন্ত্রণায় ছোটোখাটো অস্ত্র-চিকিৎসা চলিতে পারে।” দুঃখের বিষয় সে সময়কার অস্ত্র-চিকিৎসকের এ কথায় কান দেন নাই। চল্লিশ বৎসর পরে একজন আমেরিকান ডাক্তার এই গ্যাসের সাহায্যে বিনা যন্ত্রণায় একটি রোগীর দাঁত তুলিয়া দেখান যে, ডেভির কথাটা নেহাত মিথ্যা নয়। সেই অবধি নানারূপ ছোটোখাটো অস্ত্র-চিকিৎসায়, বিশেষত দাঁতের ডাক্তারিতে এই গ্যাসের ব্যবহার চলিয়া আসিতেছে।

 কিন্তু সামান্য এক মিনিট সময়ের মধ্যে তো আর রীতিমতো অস্ত্র-চিকিৎসা চলে না। সুতরাং অধিকাংশস্থলেই চিকিৎসার যন্ত্রণা দূর করিবার আর উপায় ছিল না। সেই সময়কার রোগীদের কাছে অস্ত্র-চিকিৎসার মতো ভয়ানক জিনিস আর কিছু ছিল কিনা সন্দেহ। যে কয়েদীর প্রাণদণ্ড হইবে সে যেমন করিয়া ফাঁসির কথা ভাবে, রোগী তেমনি করিয়া চিকিৎসার কথা ভাবিত। কবে ‘অস্ত্র করা' হইবে, সেই ভাবনায় রোগী আগে হইতেই আধমরা হইয়া থাকিত। প্রায় সকল রোগীকেই ধরিয়া বাঁধিয়া জবরদস্তি করিয়া তবে ছুরি চালাইতে হইত। এইরকম যখন অবস্থা তখন আমেরিকা হইতে সংবাদ আসিল সেখানকার এক ডাক্তার ‘ইথার' অর্থাৎ সুরা জাতীয় একপ্রকার ঔষধের সাহায্যে রোগীকে বহুক্ষণ নিরাপদে অজ্ঞান রাখিবার উপায় বাহির করিয়াছেন।

 জেমস্ সিম্‌সন্ নামে একটি উৎসাহী চিকিৎসক সেই সময়ে এডিনবরায় চিকিৎসা করিতেছিলেন। ছাত্র অবস্থায় সেই সময়কার অস্ত্র-চিকিৎসার ভয়ানক দৃশ্য দেখিয়া সিম্‌সন্ এক সময়ে আরেকটু হইলেই ডাক্তারি-ব্যবসায় ছাড়িয়া দিতেন। বিনা যন্ত্রণায় চিকিৎসার কথা শুনিয়া তিনিও পরীক্ষা করিতে লাগিলেন। সিম্‌সনের কয়েকটি বন্ধুও তাঁহার সহিত যোগ দিলেন। প্রতিদিন রাত্রে কয় বন্ধু মিলিয়া যত রাজ্যের ঔষধ শুঁকিয়া শুঁকিয়া নানারূপে তাহার নিশ্বাস লইয়া দেখিতেন-ঐরকম অবসাদ আসে কিনা। এ বিষয়ে তাঁহাদের কিরূপ উৎসাহ ছিল সে সম্বন্ধে সিম্‌সনের কোনো বন্ধু একটি সুন্দর গল্প লিখিয়া গিয়াছেন। ঐ বন্ধুটির বাড়িতে একটি নুতন উগ্র ঔষধ দেখিয়া সিম্‌সন্ তৎক্ষণাৎ জিনিসটা বিষাক্ত কি না তাহার বিচার না করিয়াই তাহা লইয়া পরীক্ষা করিতে উদ্যত হন। কিন্তু বন্ধুটি বাধা দিয়া আগে দুইটা খরগোসের উপর তা প্রয়োগ করেন। ফলে দুইটা খরগোসই মারা যায়।

১৮৬
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী : ২