পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/১৯৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 মরুভূমির মধ্যে আগাগোড়াই কেবল যদি বালি থাকিত, তবে তাহার ভিতরকার সংবাদ লওয়া মানুষের পক্ষে অসম্ভব হইত। কিন্তু বালির নীচেও তো জমি আছে—সেই জমির মধ্যে কত ঝরনা কত জলাশয় বালির চাপে চাপা পড়িয়া থাকে, মাঝে মাঝে যেখানে বালির চাপ কম অথবা জলের বেগ খুব বেশি সেখানে সমস্ত চাপ ঠেলিয়া জল একেবারে উপরে উঠিয়া আসে। জলের পরশ পাইয়া তাহার চারিদিকে খেজুরগাছ আর নানারকম লতাপাতা গজাইয়া উঠে, গাছের ছায়ায় ছায়ায় সমস্ত জায়গাটিকে ঠাণ্ডা করিয়া রাখে। দেখিলে মনে হয় যেন এক-একটি তীর্থস্থান। এক-একটি মরুতীর্থের ধারে ধারে ছোটোছোটো গ্রাম বসিয়া যায়—মরুপথের যাত্রীরা পথ চলিতে চলিতে এই-সকল জায়গায় আসিয়া বিশ্রাম করে।

 বাতাস যেখানে শুকনা, সেখানকার জমি অল্পেই তাতিয়া উঠে আর তাড়াতাড়ি ঠাণ্ডা হয়। সেইজন্য মরুভূমিতে যেমন গরম খুব বেশি, শীতও তেমনি প্রচণ্ড। এক সময়ে যেমন মাটিতে পা ফেলিবামাত্র ফোস্কা উঠিয়া যায়-আরেক সময় হয়তো জল জমিয়া বরফ হইয়া থাকে। দিনেরবেলা যেখানে গরমে শরীর ঝলসিয়া যায় রাত্রে সেইখানেই কম্বলের উপর কম্বল চাপাইয়া তবু শীত মানিতে চায় না। এইরূপ শীত গ্রীষ্মের লড়াইয়ের মধ্যে বাতাস বড়ো-একটা স্থির থাকিতে পারে না। যেখানেই গরম বেশি, বাতাস সেখান হইতে চিমনির ধোঁয়ার মতো উপরে উঠিতে থাকে। তখন চারিদিক হইতে ঠাণ্ডা বাতাস ঝড়ের মতো ছুটিয়া আসিয়া এক তুমুল কাণ্ড বাধাইয়া তোলে। মরুপথের বিপদ অনেক —চলিতে চলিতে পথ হারাইলে তৃষ্ণায় মরিতে হয়—চোরাবালির পাহাড় ধ্বসিয়া কত মানুষ প্রাণ হারায়-শীতে জমিয়া গরমে পুড়িয়া কত সময়ে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়। কিন্তু, যতরকম বিপদ আছে তাহার মধ্যে মানুষ সবচাইতে ভয় করে মরুভূমির ঝড়কে। সে ঝড় যে কত বড়ো সাংঘাতিক ব্যাপার হইতে পারে তাহা চোখে না দেখিলে কল্পনা করা যায় না। দমকা বাতাসের ঝাপটায় মরুভূমির তপ্ত বালি হু হু করিয়া ছুটিতে থাকে, বাতাসের আঁচে আর বালির ঘষায় সর্বাঙ্গে ফোস্কা পড়িয়া যায়, ধুলায় অন্ধ হইয়া দম আটকাইয়া মানুষগুলা পাগলের মতো ছুটিতে থাকে। তার উপর বাতাসের ঘুর্ণীটানে মরুভূমির বালি যখন পাক দিয়া উঠিতে থাকে তখন সেই বালুস্তম্ভের মুখে যে পড়ে তাহার আর রক্ষা নাই। বালির স্তম্ভে চাপা পড়িয়া কত বড়ো-বড়ো যাত্রীদল যে মারা গিয়াছে তাহার আর হিসাব নাই।

 এত বালি আসিল কোথা হইতে? সাহারা মরুভূমিতে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মণ বালি ক্রমাগত উড়িয়া উড়িয়া পশ্চিমে সমুদ্রের মধ্যে গিয়া পড়িতেছে-তবু মনে হয় বালির আর শেষ নাই। সাহারার মধ্যে এবং পুবে উতরে আশেপাশে বেলেপাথরের পাহাড়। কোনো কালে সে স্থানে সমুদ্র ছিল—তাহার নরম বালি জমাট বাঁধিয়া এখনো পাহাড় হইয়া সঞ্চিত আছে। বাতাসে সেই পাহাড়কে রেণু রেণু করিয়া উড়াইয়া মরুভূমির মধ্যে ঢলিয়া দিতেছে-আবার মরুভূমির বালিকে সেই কোথাকার সমুদ্রের মধ্যে নিয়া ফেলিতেছে। মোটের উপর দেখা যায় যে, বালি ক্ষয় হইতে হইতে ক্রমে সমস্ত মরুভূমিটাই নিচু হইয়া আসিতেছে। এখন যেখানে মরুভূমি দেখা যায় শেষে তাহারই কত জায়গায় মানুষের থাকিবার মতো চমৎকার জমি দেখা দিবে।

১৮৮
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী : ২