পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/২২৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ভূমিকম্পের নানারকম বর্ণনা বাহির হইল—কেমন করিয়া বড়ো-বড়ো গির্জার চূড়াগুলি দুলিতে দুলিতে পড়ো-পড়া হইয়াছিল, কেমন করিয়া হাইকোর্টের জজসাহেব হইতে উকিল ব্যারিস্টার পেয়াদা পর্যন্ত সবাই ছুটিয়া বাহির হইয়াছিল, কেমন করিয়া দোকানের বাবুরা আর আপিসের বড়ো-বড়ো সাহেবেরা দোকানপাট কাগজপত্র সব ফেলিয়া রাস্তায় ছুটিয়া বাহির হইয়াছিল ইত্যাদি অনেক কথা। আর জানা গেল এই যে, কেবল যে কলিকাতাতেই ভূমিকম্প হইয়াছে তাহা নয়, বাংলার নিচু জমি হইতে আসামের পাহাড় পর্যন্ত সব জায়গাতেই সেই এক কাঁপুনি।

শাস্ত্রে যে বলে পৃথিবীটা স্থির আর ‘অচলা’, পণ্ডিতেরা সে কথা অনেকদিনই মিথ্যা প্রমাণ করিয়াছেন। পৃথিবী যে শূন্যের মধ্যে প্রকাণ্ড চক্র আঁকিয়া সূর্যের চারিদিকে ছুটিয়া চলে এবং চলিতে চলিতে লাটিমের মতো ঘুরপাক খায়, এ-সকল কথা আমরা সকলেই জানি। সে চলুক আর ঘুরুক, তাহাতে আমাদের আপত্তি নাই-কারণ সেটা আমরা টের পাই না, কিন্তু মাঝে মাঝে সে আবার গা-ঝাড়া দেয় কেন? পাহাড় পর্বত কাঁপাইয়া, জমি জঙ্গল ফাটাইয়া, বাড়ি ঘর দোর উলটাইয়া এ আবার কেমন উপদ্রব? সেদিন যে ভূমিকম্প হইল, সে তো নেহাৎ সামান্যরকমের। ১৮৯৭ খৃষ্টাব্দে এ দেশে যে ভয়ানক ভূমিকম্প হইয়াছিল, তাহাতে অনিষ্ট করিয়াছিল আরো অনেক বেশি। সেবারে পূর্ববাংলায় আর আসামে অনেক লোক মারা পড়িয়াছিল এবং কলিকাতা শহরেও বড়ো-বড়ো কোঠা দালান ভাঙিয়া পড়িয়াছিল। আর রেলপুলে টেলিগ্রাফের থাম কত যে নষ্ট হইয়াছিল তাহার আর সংখ্যা নাই।

ভূমিকম্প মানে মাটির কাঁপুনি। এ কঁপুনি তো বলিতে গেলে রোজই কতবার করিয়া হইতেছে। রাস্তা দিয়া দমকল ছুটিয়া গেল, ঘোড়সোয়ার পল্টন গেল, মাটি গুম্গুম্ করিয়া কঁপিতে লাগিল। এমন-কি, একজন মোটা লোক যদি সিঁড়ি দিয়া উৎসাহ করিয়া নামিতে যায়, তাহাতেও বাড়ির ভিতরে ছোটোখাটো রকমের ভূমিকম্প হয়। যদি বেশ সূক্ষরকম যন্ত্র দিয়া পরীক্ষা করিয়া দেখ, তবে পাশের ঘরে বিড়াল হাঁটিয়া গেলে এই ঘরে তাহার চলাফিরার সাড়া পাইবে। কিন্তু ভূমিকম্প বলিতে আমরা এরকম কাঁপুনি বুঝি না। মাটির ভিতর হইতে যে ধাক্কা আসে, মাটির তলে তলে যাহা বহুদূর পর্যন্ত ছড়াইয়া পড়ে, তাহারই নাম ভূমিকম্প। কোথায় খাসিয়া পাহাড়ের মধ্যে মাটির নীচে কোন গভীর তলে একটু নাড়াচাড়া পড়িয়াছে আর সমস্ত বাংলা দেশটা ভূমিকম্পের ধাক্কায় কঁপিয়া উঠিয়াছে। সিমলা পাহাড়ে আর লঙ্কা দ্বীপে পর্যন্ত কম্পনলিপি যন্ত্রে (Seismograph) তার স্পষ্ট সাড়া পাওয়া গিয়াছে। বাস্তবিক, যাঁহারা এই-সকল সক্ষম যন্ত্রের হিসাব লইয়া কারবার করেন, তাঁহারা বলেন প্রায় প্রতিদিনই পৃথিবীর নানাস্থানে ছোটো-বড়ো নানারকমের ভূমিকম্প চলিতেছে। কয়েক বছর আগে যখন আমেরিকার সানফ্রান্সিসকো নগরে বড়ো ভূমিকম্প হইয়াছিল তখন এখানকার যন্ত্রে তাহা ধরা পড়িয়াছিল। কম্পনলিপি যন্ত্রের কাঠি একটা কাগজের উপর সাদা আঁচড় কাটিয়া চলে। যতক্ষণ ভূমিকম্পের গোলমাল না থাকে ততক্ষণ সে বরাবর সোজারকমের রেখা টানিয়া যায়, কিন্তু মাটির তলায় কোথাও যদি ভূমিকম্পের ছোঁয়া লাগে, অমনি কলের কাঠি বিগড়াইয়া হিজিবিজি আঁচড় কাটিতে আরম্ভ করে।

২১৮
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী : ২