পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/২৪২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বৎসরে দিনরাতের পরিমাণ এক সেকেণ্ডে বাড়িয়া যাইবে এবং ক্রমেই আরো বেশি করিয়া বাড়িবে। শেষে এমন দিন আসিবে যখন একপাক ঘুরিতে তাহার এক বৎসর লাগিবে। চাঁদ যেমন তাহার একই মুখ পৃথিবীর দিকে রাখিয়া পথিবীকে প্রদক্ষিণ করে, তাহার উলটা পিঠ আমাদের দেখিতেই দেয় না, পৃথিবীও ঠিক তেমনি করিয়াই ক্রমাগত একইভাবে সূর্যের দিকে মুখ ফিরাইয়া তাহার চারিদিকে ঘুরিতে থাকিবে। বুধ ও শুক্রগ্রহের আজকালকার অবস্থা ঠিক এইরূপ। এ অবস্থায় যেখানে রাত সেখানে বারো মাসই রাত, যেখানে দিন সেখানে বারো মাস দিনের আর শেষ নাই। একদিক রোদে পুড়িয়া ঝলসিয়া ঝামা হইয়া যায়, আর-একদিক শীতে জমিয়া এমন কন্কনে ঠাণ্ডা যে বাতাস জমিয়া বরফ বাঁধিয়া যায়। শেষ বয়সে, যতদিন সূর্যের তেজ থাকিবে, ততদিন এইরকম করিয়াই পৃথিবীর দিন চলিবে। তার পর সূর্যও যখন নিভিয়া যাইবে তখনো অন্ধকারে আকাশের গায়ে কত লক্ষ লক্ষ তারার আলো এমনি করিয়াই চাহিয়া থাকিবে, কিন্তু বহুদূরের সেই জ্যোতিতে আলোহারা সূর্যকে আর খুঁজিয়াই পাওয়া যাইবে না, পৃথিবী তো কোন ছার।

 পৃথিবীর মৃত্যুর কি আর কোনো উপায় নাই? হঠাৎ কোনো দুর্ঘটনা ঘটিয়া তাহার জীবনটা কি নষ্ট হইতে পারে না? ধুমকেতুকে এক সময়ে লোকে বড়োই ভয় করিত। নয় বৎসর আগে এই পৃথিবীটা যখন ‘হ্যালি'র ধমকেতুর ল্যাজের ভিতর ঢুকিয়া গিয়াছিন তখন আগে হইতেই কত লোকে ভয় পাইয়াছিল, কত লোকে বলিয়াছিল যে এইবার পৃথিবীর আর রক্ষা নাই! কিন্তু তবু তো পৃথিবীর কোনো ক্ষতি হয় নাই, বরং ধমকেতুর ধোঁয়াটে ল্যাজটাই ছিড়িয়া শূন্যে উড়িয়া গিয়াছে। এইরূপে কত ধমকেতু কত উল্কা বৃষ্টির হাত হইতে সে কতবার বাঁচিয়া আসিল, কিন্তু ধূমকেতুর চাইতে ভারি একটা কিছুর সহিত যদি তাহার ধাক্কা লাগে তাহা হইলে অবস্থাটা খুবই সাংঘাতিক হইতে পারে। সুতরাং সেই ‘একটা কিছু' আসা সম্ভব কি না, আর আসিলে কি হইবে, তাহার একটু খবর লওয়া যাক।

 পৃথিবীর দেহের বাঁধন ও চালচলন এমন হিসাব-মাফিক সুন্দর নিয়মে বাঁধা যে, হঠাৎ কিছু উলট-পালট হওয়া সম্ভব নয়। ভূমিকম্প ঝড় বৃষ্টি অগ্ন্যুৎপাত প্রভৃতি যে-সব ব্যাপারকে আমরা খুব ভয়ানক মনে করি, পৃথিবীর গায়ে সেগুলি সামান্য আঁচড় বা ফোস্কার মতো। চন্দ্র সূর্য গ্রহ উপগ্রহ প্রভৃতি সকলকেই অতি আশ্চর্য নিয়মের বাঁধনে নিরাপদ করিয়া বাঁধা হইয়াছে। সতরাং বাহির হইতে একটা কোনো উপদ্রবকে হাজির না করিলে সূর্যের এই প্রকাণ্ড সংসারটির বাঁধন ভাঙা সম্ভব বলিয়া বোধ হয় না। সুর্যদেব সপরিবারে শূন্যের ভিতর দিয়া ঘণ্টায় চল্লিশহাজার মাইল বেগে ছুটিয়া চলিয়াছেন-কিন্তু আকাশের কূল কিনারা নাই; লক্ষ লক্ষ বৎসর ক্রমাগত ছুটিয়াও তিনি যে কোনোদিন কোনো তারার উপর গিয়া পডিবেন, এমন আশংকার কোনো কারণ এ পর্যন্ত দেখা যায় নাই। কিন্তু চোখে দেখা যায় না এমনও তো অনেক বিপদ থাকিতে পারে। আকাশে যত তারা আছে তাহাদের সকলেরই যে আলো আছে এমন নয়। যাহাদের আলো নিভিয়া গিয়াছে আমরা তাহাদের কোনো খবর পাই না। সেইরূপ কোনো তারা যদি অন্ধকার পথে চলিতে চলিতে সূর্যের উপর আসিয়া পড়ে, তবে অবস্থাটা কেন হইবে? সেটা যে একেবারেই ভালো হইবে না, তাহা বুঝিতেই পার।

নানা নিবন্ধ
২৩৭