পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/২৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বাদুড় বলে, পেঁচার কুটুম কুটুমী
মানবে না কেউ তোমার এ-সব ঘুঁতুমি।
ঘুমোয় কি কেউ এমন ভুসো আঁধারে?
গিন্নী তোমার হোঁৎলা এবং হাঁদাড়ে।
তুমিও দাদা হচ্ছ ক্রমে খ্যাপাটে
চিমনি-চাটা ভোঁপসা-মুখো ভ্যাঁপাটে।

গানটা আরো চলত কিনা জানি না, কিন্তু এইপর্যন্ত হতেই একটা গোলমাল শোনা গেল। তাকিয়ে দেখি আমার আশেপাশে চারদিকে ভিড় জমে গিয়েছে। একটা সজারু এগিয়ে বসে ফোঁৎফোঁৎ করে কাঁদছে আর একটা শাম্‌লাপরা কুমির মস্ত একটা বই দিয়ে আস্তে-আস্তে তার পিঠ থাবড়াচ্ছে আর ফিস্‌ফিস্‌ করে বলছে, “কেঁদো না, কেঁদো না, সব ঠিক করে দিচ্ছি।” হঠাৎ একটা তক্‌মা-আঁটা পাগড়ি-বাঁধা কোলাব্যাঙ রুল উঁচিয়ে চীৎকার করে বলে উঠল –“মানহালির মোকদমা।”

অমনি কোত্থেকে একটা কালো ঝোল্‌লা-পরা হুতোমপ্যাঁচা এসে সকলের সামনে একটা উঁচু পাথরের উপর বসেই চোখ বুজে ঢুলতে লাগল, আর একটা মস্ত ছুঁচো একটা বিশ্রী নোংরা হাতপাখা দিয়ে তাকে বাতাস করতে লাগল।

প্যাঁচা একবার ঘোলা-ঘোলা চোখ করে চারদিক তাকিয়েই তক্ষুনি আবার চোখ বজে বলল, “নালিশ বাতলাও।”

বলতেই কুমিরটা অনেক কষ্টে কাঁদো-কাঁদো মুখ করে চোখের মধ্যে নখ দিয়ে খিমচিয়ে পাঁচ-ছয় ফোঁটা জল বার করে ফেলল। তার পর সর্দিবসা মোটা গলায় বলতে লাগল, “ধর্মাবতার হুজুর। এটা মানহানির মোকদ্দমা। সুতরাং প্রথমেই বুঝতে হবে মান কাকে বলে। মান মানে কচু। কচু অতি উপাদেয় জিনিস। কচু অনেকপ্রকার, যথা—মানকচু, ওলকচু, কান্দাকচু, মুখিকচু, পানিকচু, শঙ্খকচু, ইত্যাদি। কচুগাছের মূলকে কচু বলে, সুতরাং বিষয়টার একেবারে মূল পর্যন্ত যাওয়া দরকার।”

এইটুকু বলতেই একটা শেয়াল শাম্‌লা মাথায় তড়াক্ করে লাফিয়ে উঠে বলল, “হুজুর, কচু অতি আসার জিনিস। কচু খেলে গলা কুট্‌কুট্ করে, কচুপোড়া খাও বললে মানুষ চটে যায়। কচু খায় কারা? কচু খায় শুওর আর সজারু। ওয়াক্ থুঃ।” সজারুটা আবার ফ্যাঁৎফ্যাঁৎ করে কাঁদতে যাচ্ছিল, কিন্তু কুমির সেই প্রকাণ্ড বই দিয়ে তার মাথায় এক থাবড়া মেরে জিজ্ঞাসা করল, “দলিলপত্র সাক্ষী-সাবুদ কিছু আছে?” সজারু নেড়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “ঐ তো ওর হাতে সব দলিল রয়েছে।” বলতেই কুমিরটা নেড়ার কাছ থেকে একতাড়া গানের কাগজ কেড়ে নিয়ে হঠাৎ এক জায়গা থেকে পড়তে লাগল—

একের পিঠে দুই
গোলাপ চাঁপা জুঁই
সান্‌ বাঁধানো ভুঁই
চৌকি চেপে শুই
ইলিশ মাগুর রুই
গোবর জলে ধুই
পোটলা বেধে থুই
হিন্‌চে পালং পুঁই
কাঁদিস কেন তুই।
২২
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী: ২