পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/২৭১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে! এই ছবিগুলো যদি খুব তাড়াতাড়ি একটার পর একটা ঠিকমত তোমার চোখের সামনে ধরে দেওয়া যায়, তা হলে তোমার মনে হবে সত্যি সত্যি যেন ছবিতে সঙটা ডিগবাজি খাচ্ছে।

 আজকাল যে শহরে শহরে, এমন-কি, পাড়াগাঁয়ে পর্যন্ত লোকেরা বায়োস্কোপ দেখে তার সংকেতও এইরকম। খুব চট্‌পট্ করে যদি কোনো চলতি জিনিসের অনেকগুলো ফোটো নেওয়া হয়—আর তার পর যদি সেই ফোটোগুলোকে তেমনি তাড়াতাড়ি, সেকেণ্ডে দশ-বারোটা করে পরপর চোখের সামনে ধরে দেখানো হয়, তা হলেই বায়োস্কোপ দেখানো হল। মনে কর, বায়োস্কোপে তোমার, ভাত-খাওয়ার ছবি নেওয়া হচ্ছে। তা হলে কিরকম হবে? প্রথম ছবিতে হয়তো তুমি ভাতের গ্রাস ধরেছ, তোমার মুখটা তখনো বোজা আছে। দ্বিতীয় ছবিতে থালা থেকে তোমার হাত উঠছে, মুখটাও একটু খুলতে চাচ্ছে। তৃতীয় ছবিতে হাতখানা আরো উঠেছে, মুখেও বেশ ফাঁক দেখা দিয়েছে। তার পর হাতটা ক্রমেই মুখের কাছে এগিয়ে আসছে আর মুখের হাঁটাও বেশ বড়ো হয়ে আসছে। তার পর হাত গিয়ে মুখে ঠেকেছে, তার পর মুখের মধ্যে গ্রাস ঢুকছে ইত্যাদি।

 প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে প্রথম যে বায়োস্কোপের ছবি তোলা হয়েছিল, সেই ছবি তুলবার জন্য চব্বিশটা ফোটোগ্রাফের কল পর পর সাজানো হয়েছিল আর প্রত্যেকটা কলের সামনে এক-একটা সুতো এমনভাবে টেনে বাধা হয়েছিল যে ঘোড়াটা কলের সামনে দিয়ে যেতে গেলেই সুতো ছিঁড়ে যাবে, আর ক্যামেরাতে ঘোড়ার ফোটো উঠে যাবে। আজকালকার বায়োস্কোপকলের বন্দোবস্ত এরকম নয়। তাতে একটা লম্বা ফিতের উপর পর পর হাজার হাজার ছোটোছোটো ফোটো তোলা হয়। এক-একটা ছবি ওঠে আর ফিতেটা এক-এক ঘর সরে যায়। এমন করে প্রত্যেক সেকেণ্ডে দশ-বারোটা করে ফোটো তোলা হয়-ঘণ্টায় প্রায় চল্লিশহাজার!

 এমন কলও তৈরি হয়েছে যাতে প্রতি সেকেণ্ডে পাঁচহাজার ফোটো তোলা যায়। এইরকম তাড়াতাড়ি ফোটো তুলে তার পর যদি দেখাবার সময়ে বেশ ধীরে ধীরে সাধারণ বায়োস্কোপের ছবির মতো দেখানো হয় তা হলে খুব দ্রুত ঘটনার ছবিও বেশ স্পষ্ট করে সহজভাবে দেখবার সুবিধা হয়। একটা সাবানের বুদ্বুদের ভিতর দিয়ে বন্দুকের গুলি ছুটে গেলে বুদ্বুদটা কিরকম করে ফেটে যায় তাও দেখানো যায়। চোখে দেখলে এই ব্যাপারটা হঠাৎ এক মুহর্তে শেষ হয়ে যায়-বন্দুক ছুটল আর বুদ্বুদ ফাটল এইটুকুই খালি বোঝা যায়। কিন্তু ছবিতে স্পষ্ট করে দেখা যায় কেমন করে গুলিটা বুদটাকে ফুটো করে ঢোকে, আবার ফুঁড়ে বেরিয়ে যায়, আর বুদ্বটাও ফেটে চুপসে একেবারে মিলিয়ে যায়। আবার যেব্যাপারটা ঘটতে অনেক সময় লাগে তাকেও বায়োস্কোপের ছবিতে খুব অল্প সময়য়ের মধ্যে চটপট ঘটিয়ে দেখানো যায়। ফুলগাছের টবে সবেমাত্র অঙ্কুর গজাচ্ছে, সেই অঙ্কুর থেকে গাছ হবে, সেই গাছ বাড়বে, তাতে কুঁড়ি ধরবে, তার পর ফুল ফুটবে-বসে বসে দেখতে গেলে কতদিন সময় লাগে! বায়োস্কোপে যদি তার ছবি তোল, এক-এক দিনে দশ-বারোটা বা পঁচিশ-ত্রিশটা করে আর দেখবার সময় চটপট দেখিয়ে যাও—তা হলে দেখবে যেন চোখের সামনেই দেখতে দেখতে গাছ গজিয়ে বেড়ে উঠছে আর ফুল ফুটছে!

সন্দেশ-ভাদ্র, ১৩২৭
২৬৬
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী : ২