পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/৩১৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

তাকে তেড়ে কামড়াতে গিয়েছিল- খেলোয়াড় তখন পোশাক বদলিয়ে পুরানো পোশাক পরে এসে তার পর খাঁচায় ঢুকতে গেল। আর-একবার এক মেমসাহেব একসঙ্গে পাঁচ-সাতটা সিংহের খেলা দেখাতে গিয়ে এইরকম বিপদে পড়েছিলেন। সেদিন তার হাতে একটা ফুলের তোড়া ছিল, একটা সিংহ তাই দেখে বোধ হয় মাংস না কি মনে করে হঠাৎ তার উপর এক থাবা মেরে বসেছে। ঐ একটি থাবায় মেমসাহেবের গালের আর হাতের মাংসসুদ্ধ উঠিয়ে নিয়েছে আর অমনি চক্ষের নিমেষে সবকটা সিংহ একেবারে হাঁ হাঁ করে ফুলের তোড়াটার দিকে তেড়ে এসেছে। মেমসাহেবটি তখন বুদ্ধি করে তোড়াটা ছুড়ে ফেলে দিলেন, তাই রক্ষা, তা নইলে অতগুলো সিংহের হুড়াহুড়ির মধ্যে পড়ে তাকে আর বাঁচতে হত না। যাহোক, ফুলটা মাটিতে পড়তেই সিংহগুলো তাকে নেড়ে এঁকে নাক সিটকিয়ে আবার যে যার জায়গায় ফিরে গেল।

 একবার বার্মিংহাম শহরে বোস্টক সাহেবের একটা সংহ খাঁচা থেকে পালিয়ে শহরের রাস্তায় এসে হাজির হয়েছিল। শহরের মধ্যে স্থল পড়ে গেল, রাস্তায় লোকজনের চলাফেরা বন্ধ হয়ে গেল। দোকানীরাও তাদের দোকানপাট খুলতে চায়। সিংহটা এদিক-ওদিক ঘুরে শেষটায় একটা প্রকাণ্ড ড্রেনের নর্দমায় গিয়ে ঢুকে বসল, আর সেখান থেকে সে বেরোতে চায় না। সেই নর্দমার ভিতর দিয়ে সেই রাস্তার নীচে চলাফিরা করে আর মাঝে মাঝে ডাক ছাড়ে। রাত দুপুরে মাটির নীচ থেকে ঐরকম গুরুগম্ভীর আওয়াজ-অবস্থাখানা কিরকম বুঝতেই পার। শেষটা নর্দমার মুখে একটা খাঁচা বসিয়ে সিংহটাকে তাড়িয়ে সেটার মধ্যে নেবার কথা হল। কিন্তু অনেক তাড়া করেও সিংহটাকে নড়ানো গেল না। সকলের চীৎকার, বড়ো-বড়ো পাথরের আঘাত আর লম্বা-লম্বা বাঁশের খোচা সে-সব সহ্য করে সে চুপচাপ বসে রইল। তার পর কুকুর লেলিয়ে দেওয়া হল, বোস্টক সাহেব নিজে তার নাকের আগায় এক ঘা জুতো মেরে আসিলেন কিন্তু সিংহ সেখান থেকে নড়ে না। হয়রান হয়ে পছে এমন সময় একজন লোকের হাত থেকে একটা বালতি কেমন করে ফস্কে গিয়ে গড়্ গড়্, শব্দ করে নর্দমার মধ্যে গড়িয়ে গিয়েছে। সেই আওয়াজ শুনে সিংহমশাই এক দৌড়ে ল্যাজ গুটিয়ে একেবারে খাঁচার মধ্যে।

 আর-একবার একটা পলাতক সিংহকে পটকা ছুড়ে ভয় দেখিয়ে খাঁচার মধ্যে ঢোকানো হয়েছিল। সতরাং সিংহের যেমন একদিকে খুব সাহস, আর এদিকে তেমনি ভয়ও আছে। বোস্টক সাহেব বলেন, মানুষের যেমন নানারকমের মেজাজ থাকে—কেউ ঠাণ্ডা কেউ চটা, কেউ হাবাগোছের, কেউ চটপট-এই-সব জানোয়ারদেরও তেমনি। এক-একটা সিংহের চাল-চলন বুদ্ধি শুদ্ধি এক-একরকমের। কোনো পোষ মানে একেবারে কুকুরের মতো কোনোটা হয়তো কোনোকালেই ঠিকমতো পোষ মানে না—তাকে সর্বদা চোখে চোখ রাখতে হয়। সিংহ পশুরাজ, তাই তার কথাই বেশি করে বললাম, কিন্তু জানোয়ারের মধ্যে হাতির সম্মানও বড় কম নয়। বিশেষত বিলাতে ও আমেরিকায়—যেখানে হাতি সর্বদা দেখা যায় না- সেখানে হাতিকে লোকে খুবই খাতির করে। বোস্টক সাহেবের কতগুলো হাতি আছে, তাদের তোয়াজ করবার জন্য অনেকগুলি চাকর সর্বদা লেগে আছে। আমার দেশে হাতিগুলো রোজ স্নান করবার সময় তানেকক্ষণ জলে কাদায়

৩০৮
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী : ২