বিবিধ প্রসঙ্গ/আদর্শ প্রেম

উইকিসংকলন থেকে

আদর্শ প্রেম।

 সংসারের কাজ-চালানে, মন্ত্রবদ্ধ, ঘর কন্নার ভালবাসা যেমনই হউক আমি প্রকৃত আদর্শ ভালবাসার কথা বলিতেছি। যে হউক এক জনের সহিত ঘেঁষাঘেষি করিয়া থাকা, এক ব্যক্তির অতিরিক্ত একটি অঙ্গের ন্যায় হইয়া থাকা তাহার পাঁচটা অঙ্গুলির মধ্যে ষষ্ঠ অঙ্গুলির ন্যায় লগ্ন হইয়া থাকাকেই ভালবাসা বলে না। দুইটা আঠাবিশিষ্ট পদার্থকে একত্রে রাখিলে সে জুড়িয়া যায়, সেই জুড়িয়া যাওয়াকেই ভালবাসা বলে না। অনেক সময়ে আমরা নেশাকে ভালবাসা বলি। রাম ও শ্যাম উভয়ে উভয়ের কাছে হয় ত “মৌতাতের” স্বরূপ হইয়াছে, রাম ও শ্যাম উভয়কে উভয়ের অভ্যাস হইয়া গিয়াছে, রামকে নহিলে শ্যামের বা শ্যামকে নহিলে রামের অভ্যাস ব্যাঘাতের দরুন কষ্ট বোধ হয়। ইহাকে ও ভালবাসা বলে না। প্রণয়ের পাত্র নীচই হউক, নিষ্ঠুরই হউক্, আর কুচরিত্রই হউক্, তাহাকে আঁকড়িয়া ধরিয়া থাকাকে অনেকে প্রণয়ের পরাকাষ্ঠা মনে করিয়া থাকে। কিন্তু, ইহা বিবেচনা করা উচিত, নিতান্ত অপদার্থ দুর্ব্বল-হৃদয় নহিলে কেহ নীচের কাছে নীচ হইতে পারে না। এমন অনেক ক্রীতদাসের কথা শুনা গিয়াছে, যাহারা নিষ্ঠুর, নীচাশয় প্রভুর প্রতি অন্ধভাবে আমত্ত। কুকুরেরাও সেইরূপ। এরূপ কুকুরের মত, ক্রীতদাসের মত ভালবাসাকে ভালবাসা বলিতে কোন মতেই মন উঠে না। প্রকৃত ভালবাসা দাস নহে, সে ভক্ত; সে ভিক্ষুক নহে সে ক্রেতা। আদর্শ প্রণয়ী প্রকৃত সৌন্দর্য্যকে ভালবাসেন, মহত্বকে ভালবাসেন; তাঁহার হৃদয়ের মধ্যে যে আদর্শ ভাব জাগিতেছে, তাহারই প্রতিমাকে ভালবাসেন। প্রণয়ের পাত্র যেমনই হউক, অন্ধভাবে তাহার চরণ আশ্রয় করিয়া থাকা তাঁহার কর্ম্ম নহে। তাহাকে ত ভালবাসা বলে না তাহাকে কর্দ্দম-বৃত্তি বলে। কর্দ্দম একবার পা জড়াইলে আর ছাড়তে চায় না, তা সে যাহারই পা হউক না কেন, দেবতারই হউক্ আর নরাধমেরই হউক্। প্রকৃত ভালবাসা যোগ্যপাত্র দেখিলেই আপনাকে তাহার চরণধূলি করিয়া ফেলে। এই নিমিত্ত ধূলিবৃত্তি করাকেই অনেকে ভালবাসা বলিয়া ভুল করেন। তাঁহারা জানেন না যে, দাসের সহিত ভক্তের বাহ্য আবরণে অনেক সাদৃশ্য আছে বটে, কিন্তু একটি প্রধান প্রভেদ আছে, ভক্তের দাসত্বে স্বাধীনতা আছে, ভক্তের স্বাধীন দাসত্ব। তেমনি প্রকৃত প্রণয় স্বাধীন প্রণয়। সে দাসত্ব করে কেননা দাসত্ব বিশেষের মহত্ব সে বুঝিয়াছে। যেখানে দাসত্ব করিয়া গৌরব আছে, সেই খানেই সে দাস, যেখানে হীনতা স্বীকার করাই মর্য্যাদা, সেই খানেই সে হীন। ভালবাসিবার জন্যই ভালবাসা নহে, ভাল ভালবাসিবার জন্যই ভালবাসা। ত।’ যদি না হয়, যদি ভালবাসা হীনের কাছে হীন হইতে শিক্ষা দেয়, যদি অসৌন্দর্যের কাছে রুচিকে বদ্ধ করিয়া রাখে তবে ভালবাসা নিপাত যাক্।