রাজর্ষি/চত্বারিংশ পরিচ্ছেদ: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য
Jayantanth (আলোচনা | অবদান) অ Jayantanth রাজর্ষি-৪০ পাতাটিকে রাজর্ষি/চত্বারিংশ পরিচ্ছেদ শিরোনামে কোনো পুনর্নির্দেশনা ছাড়াই স্থানান্তর করেছেন |
Jayantanth (আলোচনা | অবদান) + ট্যাগ: প্রতিস্থাপিত |
||
১ নং লাইন: | ১ নং লাইন: | ||
⚫ | |||
{{শীর্ষক |
{{শীর্ষক |
||
|শিরোনাম=[[ |
|শিরোনাম=[[../]] |
||
|আদ্যক্ষর= |
|আদ্যক্ষর= |
||
|অনুচ্ছেদ = |
|অনুচ্ছেদ = |
||
|পূর্ববর্তী =[[ |
|পূর্ববর্তী =[[../ঊনচত্বারিংশ পরিচ্ছেদ/]] |
||
|পরবর্তী =[[ |
|পরবর্তী =[[../একচত্বারিংশ পরিচ্ছেদ/]] |
||
|টীকা = |
|টীকা = |
||
|লেখক =রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর |
|লেখক =রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর |
||
|বছর = |
|বছর = ১৮৮৭ |
||
|প্রবেশদ্বার = |
|প্রবেশদ্বার = |
||
}} |
}} |
||
<div style=" |
<div style="text-align: justify;"> |
||
<poem> |
|||
⚫ | |||
রঘুপতি আবার মন্দিরে ফিরিয়া গেলেন। গিয়া দেখিলেন, কোনো প্রেমপূর্ণ হৃদয় বসত্রাদি লইয়া তাঁহার জন্য অপেক্ষা করিয়া নাই। পাষাণমন্দির দাঁড়াইয়া আছে, তাহার মধ্যে কোথাও হৃদয়ের লেশমাত্র নাই। তিনি গিয়া গোমতীতীরের শ্বেত সোপানের উপর বসিলেন। সোপানের বাম পার্শ্বে জয়সিংহের স্বহস্তে রোপিত শেফালিকা গাছে অসংখ্য ফুল ফুটিয়াছে। এই ফুলগুলি দেখিয়া জয়সিংহের সুন্দর মুখ, সরল হৃদয়, সরল জীবন এবং অত্যন্ত সহজ বিশুদ্ধ উন্নত ভাব তাঁহার স্পষ্ট মনে পড়িতে লাগিল। সিংহের ন্যায় সবল তেজস্বী এবং হরিণশিশুর মতো সুকুমার জয়সিংহ রঘুপতির হৃদয়ে সম্পূর্ণ আবির্ভূত হইল, তাঁহার সমস্ত হৃদয় অধিকার করিয়া লইল। ইতিপূর্বে তিনি আপনাকে জয়সিংহের চেয়ে অনেক বড়ো জ্ঞান করিতেন, এখন জয়সিংহকে তাঁহার নিজের চেয়ে অনেক বড়ো মনে হইতে লাগিল। তাঁহার প্রতি জয়সিংহের সেই সরল ভক্তি সমরণ করিয়া জয়সিংহের প্রতি তাঁহার অত্যন্ত ভক্তির উদয় হইল, এবং নিজের প্রতি তাঁহার অভক্তি জন্মিল। জয়সিংহকে যেসেকল অন্যায় তিরস্কার করিয়াছেন তাহা সমরণ করিয়া তাঁহার হৃদয় বিদীর্ণ হইল। তিনি মনে মনে কহিলেন, “জয়সিংহের প্রতি ভর্ৎসনার আমি অধিকারী নই। জয়সিংহের সহিত যদি এক মুহূর্তের জন্য একটিবার দেখা হয়, তবে আমি আমার হীনত্ব স্বীকার করিয়া তাহার নিকট একবার মার্জনা প্রার্থনা করিয়া লই।” জয়সিংহ যখন যাহা যাহা বলিয়াছে করিয়াছে সমস্ত তাঁহার মনে পড়িতে লাগিল। জয়সিংহের সমস্ত জীবন সংহত ভাবে তাঁহার মধ্যে বিরাজ করিতে লাগিল। তিনি এইরূপ একটি মহৎ চরিত্রের মধ্যে আত্মবিস্মৃত হইয়া সমস্ত বিবাদ বিদ্বেষ ভুলিয়া গেলেন। চারি দিকের গুরুভার সংসার লঘু হইয়া গিয়া তাঁহাকে পীড়ন করিতে বিরত হইল। যে নক্ষত্রমাণিক্যকে তিনিই রাজা করিয়া দিয়াছেন সে যে রাজা হইয়া আজ তাঁহাকেই অপমান করিয়াছে ইহা সমরণ করিয়া তাঁহার কিছুমাত্র রোষ জন্মিল না। এই মান-অপমান সমস্তই সামান্য মনে করিয়া তাঁহার ঈষৎ হাসি আসিল। কেবল তাঁহার ইচ্ছা করিতে লাগিল জয়সিংহ যাহাতে যথার্থ সন্তুষ্ট হয় এমন একটা কিছু কাজ করেন। অথচ চতুর্দিকে কাজ কিছুই দেখিতে পাইলেন না–চতুর্দিকে শূন্য হাহাকার করিতেছে। এই বিজন মন্দির তাঁহাকে যেন চাপিয়া ধরিল, তাঁহার যেন নিশ্বাস রোধ করিল। একটা কিছু বৃহৎ কাজ করিয়া তিনি হৃদয়বেদনা শান্ত করিয়া রাখিবেন, কিন্তু এই-সকল নিস্তব্ধ নিরুদ্যম নিরালায় মন্দিরের দিকে চাহিয়া পিঞ্চরবদ্ধ পাখির মতো তাঁহার হৃদয় অধীর হইয়া উঠিল। তিনি উঠিয়া বনের মধ্যে অধীর ভাবে পদচারণ করিতে লাগিলেন। মন্দিরের ভিতরকার অলস অচেতন অকর্মণ্য জড়প্রতিমাগুলির প্রতি তাঁহার অতিশয় ঘৃণার উদয় হইল। হৃদয় যখন বেগে উদ্বেল হইয়া উঠিয়াছে তখন কতকগুলি নিরুদ্যম সথূল পাষাণ-মূর্তির নিরুদ্যম সহচর হইয়া চিরদিন অতিবাহিত করা তাঁহার নিকটে অত্যন্ত হেয় বলিয়া বোধ হইল। যখন রাত্রি দ্বিতীয় প্রহর হইল, রঘুপতি চক্মকি ঠুকিয়া একটি প্রদীপ জ্বালাইলেন। দীপহস্তে চতুর্দশ দেবতার মন্দিরের মধ্যে প্রবেশ করিলেন। গিয়া দেখিলেন, চতুর্দশ দেবতা সমান ভাবেই দাঁড়াইয়া আছে; গত বৎসর আষাঢ়ের কালরাত্রে ক্ষীণ দীপালোকে ভক্তের মৃতদেহের সম্মুখে রক্তপ্রবাহের মধ্যে যেমন বুদ্ধিহীন হৃদয়হীনের মতো দাঁড়াইয়া ছিল, আজও তেমনি দাঁড়াইয়া আছে। |
|||
{{page break|label=}} |
|||
রঘুপতি চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠিলেন, “মিথ্যা কথা! সমস্ত মিথ্যা! হা বৎস জয়সিংহ, তোমার অমূল্য হৃদয়ের রক্ত কাহাকে দিলে! এখানে কোনো দেবতা নাই, কোনো দেবতা নাই। পিশাচ রঘুপতি সে রক্ত পান করিয়াছে।” |
|||
বলিয়া কালীর প্রতিমা রঘুপতি আসন হইতে টানিয়া তুলিয়া লইলেন। মন্দিরের দ্বারে দাঁড়াইয়া সবলে দূরে নিক্ষেপ করিলেন। অন্ধকারে পাষাণসোপানের উপর দিয়া পাষাণপ্রতিমা শব্দ করিয়া গড়াইতে গড়াইতে গোমতীর জলের মধ্যে পড়িয়া গেল। অজ্ঞানরাক্ষসী পাষাণ-আকৃতি ধারণ করিয়া এতদিন রক্তপান করিতেছিল, সে আজ গোমতীগর্ভের সহস্র পাষাণের মধ্যে অদৃশ্য হইল, কিন্তু মানবের কঠিন হৃদয়াসন কিছুতেই পরিত্যাগ করিল না। রঘুপতি দীপ নিবাইয়া দিয়া পথে বাহির হইয়া পড়িলেন, সেই রাত্রেই রাজধানী ছাড়িয়া চলিয়া গেলেন। |
|||
</poem> |
|||
</div> |
</div> |
||
{{Footer|রাজর্ষি-৪১}} |
১৯:১৫, ৫ অক্টোবর ২০১৮ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
চত্বারিংশ পরিচ্ছেদ
রঘুপতি আবার মন্দিরে ফিরিয়া গেলেন। গিয়া দেখিলেন, কোনো প্রেম পূর্ণ হৃদয় বস্ত্রাদি লইয়া তাহার জন্য অপেক্ষা করিয়া নাই। পাষাণমন্দির দাড়াইয়া আছে, তাহার মধ্যে কোথাও হৃদয়ের লেশমাত্র নাই। তিনি গিয়া গোমতীতীরের শ্বেত সোপানের উপর বসিলেন। সোপানের বাম পার্শ্বে জয়সিংহের স্বহস্তে রোপিত শেফালিকা গাছে অসংখ্য ফুল ফুটিয়াছে। এই ফুলগুলি দেখিয়া জয়সিংহের সুন্দর মুখ, সরল হৃদয় সরল জীবন এবং অত্যন্ত সহজ বিশুদ্ধ উন্নত ভাব তাঁহার স্পষ্ট মনে পড়িতে লাগিল। সিংহের দ্যায় সবল তেজস্বী এবং হরিণশিশুর মতে: মুকুমার জয়সিংহ রঘুপতির হৃদয়ে সম্পূর্ণ আবিভূতি হইল, তাঁহার সমস্ত হৃদয় অধিকার করিয়া লইল। ইতিপূর্বে তিনি আপনাকে জয়সিংহের চেয়ে অনেক বড়ো জ্ঞান করিতেন, এখন জয়সিংহকে তাহার নিজের চেয়ে অনেক বড়ো মনে হইতে লাগিল। তাহার প্রতি জয়সিংহের সেই সরল ভক্তি স্মরণ করিয়া জয়সিংহের প্রতি তাঁহার অত্যন্ত ভক্তির উদয় ছইল, এবং নিজের প্রতি তাঁহার অভক্তি জন্মিল। জয়সিংহকে যে-সকল অম্ভায় তিরস্কার করিয়াছেন তাহা স্মরণ করিয়া তাহার হৃদয় বিদীর্ণ হইল। তিনি মনে মনে কহিলেন,'জয়সিংহকে ভৎপনার আমি অধিকারী নই;"জয়সিংহের সহিত যদি এক মুহুর্তের জন্য একটিবার দেখা হয় তবে আমি আমার হীনত্ব স্বীকার করিয়া তাহার নিকট একবার মার্জনা প্রার্থনা করি। জয়সিংহ যখন যাহা যাহ। বসিয়াছে করিয়াছে, সমস্ত তাহার মনে পড়িতে লাগল॥ জয়সিংহের সমস্ত জীবন সংহত ভাবে তাহার মধ্যে বিরাজ করিতে লাগিল। তিনি এইরূপ একটি মহৎ চরিত্রের মধ্যে আত্মবিশ্বত হুইয়া সমস্ত। বিবাদ বিদ্বেষ তুলিয়া গেলেন। চারি দিকের গুরুভার সংসার লঘু হইয়া গিয়া তাহাকে পীড়ন করিতে বিরত হইল। যে নক্ষত্রমাণিক্যকে তিনিই রাজ্য করিয়া দিয়াছেন সে যে রাজা হইয়া তাহাকেই অপমান করিয়াছে ইহা স্মরণ করিয়া তাহার কিছুমাত্র রোষ। জন্মিল না। এই মান-অপমান সমস্তই সামা্য মনে করিয়া তাRার ঈষৎ হাসি আসিল। কেবল তাঁহার ইচ্ছা করিতে লাগিল, জয়সিংহ যাহাতে যথার্থ সন্তুষ্ট হয় এমন একটাকিছু কাজ করেন॥ অথচ চতুদিকে কাজ কিছুই দেখিতে পাইলেন না— চতুর্দিকে শূন্ত হাহাকার করিতেছে। এই বিজন মন্দির 'হা!কে যেন চাপিয়া ধরিল, তাঁহার যেন নিশ্বাস রোধ করিল। একটাকিছু বৃৎ কাজ করিয়া তিনি হৃদয়বেদনা শাস্ত করিয়া রাখিবেন, কিন্তু এই-সকল নিস্তব্ধ নিরুদ্যম নিরালয় মন্দিরের দিকে চাহিয়া পিঞ্জরবদ্ধ পাখির মতো তাহার হৃদয় অধীর হইয়া উঠিল। তিনি উঠিয় বনের মধ্যে অধীর ভাবে পদচারণ করিতে লাগিলেন। মন্দিরের ভিতরকার অলস অচেতন অকৰ্মণ্য জড়প্রতিমাগুলির প্রতি তাহার অতিশয় স্থণার উদয় হইল। হৃদয় যখন বেগে উন্দুবেল হইয়া উঠিয়াছে তখন কতকগুলি নিরুদাম ঘূল পাসাণমূতির নিরুম সহচর হইয়া চিরদিন অতিবাহিত করতাহার নিকটে অতাও হেয় বলিয়া বোধ হইল। যখন রাত্রি দ্বিতীয় প্রহর হইল, রঘুপতি চকমকি পুঁকিয়া একটি প্রদীপ জালাইলেন। দীপ-হস্তে চতুর্দশ দেবতার মন্দিরের মধ্যে প্রবেশ করিলেন। গিয়া দেখিলেন, চতুর্দশ দেবতা সমান ভাবেই দাড়াইয়া আছে; গত বৎসর আষাঢ়ের কালরাত্রে ক্ষীণ দীপালোকে ভক্তের মৃতদেহের সম্মুখে রক্ত প্রবাহের মধ্যে যেমন বুদ্ধিহীন হৃদয়হীনের মতো দাড়াইয়া ছিল, আজও তেমনি দাড়াইয়া আছে। রঘুপতি চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠিলেন, মিথ্যা কথা! সমস্ত মিথ্যা! হা বৎস জয়সিংহ, তোমার অমূল্য হৃদয়ের যুক্ত কাহাকে দিলে! এখানে কোনো দেবতা নাই, কোনে। দেবতা নাই! পিশাচ রঘুপতি সে রক্ত পান করিয়াছে!” বলিয়া কালীর প্রতিমা রপতি আসন হইতে টানিয়া তুলিয়া লইলেন। মন্দিরের দ্বারে দাড়াইয়া সবলে। রে নিক্ষেপ করিলেন। অন্ধকারে পাবাণসোপানের উপর দিয়া পাষাণ প্রতিমাশব্দ করিয়া গড়াইতে গড়াইতে গোমতীর জলের মধ্যে পড়িয়া গেল। অজ্ঞানরাক্ষসী পাষাণ-আকৃতি ধারণ করিয়া এতদিন রক্তপান করিতেছিল, সে আজ গোমতীগর্ভের সহস্র পাষাণের মধ্যে অদৃশ্য হইল, কিন্তু মানবের কঠিন হৃদয়াসন কিছুতেই পরিত্যাগ করিল না। রঘুপতি দীপ নিবাইয়া দিয়া পথে বাহির হইয়া পড়িলেন, সেই রাত্রেই রাজধানী ছাড়িয়া চলিয়া গেলেন।