যোগাযোগ/১৩

উইকিসংকলন থেকে

১৩

 অঘ্রান মাসে বিয়ে। পঁচিশে আশ্বিন লক্ষ্মীপূজো হয়ে গেল। হঠাৎ সাতাশে আশ্বিনে তাঁবু ও নানাপ্রকার সাজসরঞ্জাম নিয়ে ঘোষাল-কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ওভারসিয়র এসে উপস্থিত, সঙ্গে একদল পশ্চিমি মজুর। ব্যাপারখানা কী? শেয়াকুলিতে ঘোষালদিঘির ধারে তাঁবু গেড়ে বর ও বরযাত্রীরা কিছুদিন আগে থাকতেই সেখানে এসে উঠবেন।

 এ কী রকম কথা? বিপ্রদাস বললে, “তাঁরা যতজন খুশি আসুন, যতদিন খুশি থাকুন, আমরাই বন্দোবস্ত করে দেব। তাঁবুর দরকার কী? আমাদের স্বতন্ত্র বাড়ি আছে, সেটা খালি করে দিচ্ছি।”

 ওভারসিয়র বললে, “রাজাবাহাদুরের হুকুম। দিঘির চারিধারের বনজঙ্গলও সাফ করে দিতে বলেছেন,—আপনি জমিদার, অনুমতি চাই।”

 বিপ্রদাস মুখ লাল করে বললে, “এটা কি উচিত হচ্ছে? জঙ্গল তো আমবাই সাফ করে দিতে পারি।”

 ওভারসিয়র বিনীতভাবে উত্তর করলে, “ওইখানেই রাজাবাহাদুরের পূর্বপুরুষের ভিটেবাড়ি, তাই শখ হয়েছে নিজেই ওটা পরিষ্কার করে নেবেন।”

 কথাটা নিতান্ত অসংগত নয়, কিন্তু আত্মীয়স্বজনেরা খুঁত খুঁত করতে লাগল। প্রজারা বলে, এটা আমাদের কর্তাবাবুদের উপর টেক্কা দেবার চেষ্টা। হঠাৎ তবিল ফেঁপে উঠেছে, সেটা ঢাকা দিতে পারছে না; সেটাকে জয়ঢাক করে তোলবার জন্যেই না এই কাণ্ড? সাবেক আমল হলে বরসুদ্ধ বরসজ্জা বৈতরণী পার করতে দেরি হত না। ছোটোবাবু থাকলে তিনিও সইতেন না, দেখা যেত ওই বাবুগুলো আর তাঁবুগুলো থাকত কোথায়।

 প্রজারা এসে বিপ্রদাসকে বললে, “হুজুর ওদের কাছে হটতে পারব না। যা খরচ লাগে আমরাই দেব।”

 ছয়-আনার কর্তা নবগোপাল এসে বললে, “বংশের অমর্যাদা সওয়া যায় না। একদিন আমাদের কর্তারা ওই ঘোষালদের হাড়ে হাড়ে ঠকাঠকি লাগিয়েছেন, আজ তারা আমাদেরই এলাকার উপর চড়াও হয়ে টাকার ঝলক মারতে এসেছে। ভয় নেই দাদা, খরচ যা লাগে আমরাও আছি। বিষয় ভাগ হোক বংশের মান তো ভাগ হয়ে যায় নি।”

 এই বলে নবগোপালই ঠেলেঠুলে কর্মকর্তা হয়ে বসল।

 বিপ্রদাস কয়দিন কুমুর কাছে যেতে পারে নি। তার মুখের দিকে তাকাবে কী করে? কুমুর কাছে বরপক্ষের স্পর্ধার কথা কেউ যে গলা খাটো করে বলবে সমাজে সে-দয়া বা ভদ্রতা নেই। তারই কাছে সবাই বাড়িয়ে-বাড়িয়ে বলে। মেয়েদের রাগ তারই ’পরে। ওরই জন্যে পূর্বপুরুষের মাথা যে হেঁট হল। রাজরানী হতে চলেছেন! কীযে রাজার ছিরি!

 জাতকুলের কথাটাকে কুমু তার ভক্তি দিয়ে চাপা দিয়েছিল। কিন্তু ধনের বড়াই করে শ্বশুরকুলকে খাটো করার নীচতা দেখে তার মন বিষাদে ভরে উঠল। কেবলই লোকের কাছ থেকে সে পালিয়ে বেড়ায়। ঘোষালদের লজ্জায় আজ যে ওরই লজ্জা। দাদার মুখ থেকে কিছু শোনবার জন্যে মনটা ছটফট করছে। কিন্তু দাদার দেখা নেই, অন্দরমহলে খেতেও আসে না।

 একদিন বিপ্রদাস অন্তঃপুরের বাগানে ভিয়েনঘরের জন্যে চালা বাঁধবার জায়গা ঠিক করতে গিয়ে হঠাৎ খিড়কির পুকুরের ঘাটে দেখে কুমু নিচের পৈঠের উপর বসে মাথা হেঁট করে জলের দিকে তাকিয়ে আছে। দাদাকে দেখে তাড়াতাড়ি উপরে উঠে এল। এসেই রুদ্ধস্বরে বললে, “দাদা, কিছুই বুঝতে পারছি নে।” বলেই মুখে কাপড় দিয়ে কেঁদে উঠল।

 দাদা ধীরে ধীরে পিঠে হাত বুলিয়ে বললে, “লোকের কথায় কান দিস নে বোন।”

 “কিন্তু ওঁরা এ-সব কী করছেন? এতে কি তোমাদের মান থাকবে?”

 ওদের দিকটাও ভেবে দেখিস। পূর্বপুরুষের জন্মস্থানে আসছে, ধুমধাম করবে না? বিয়ের ব্যাপার থেকে এটাকে স্বতন্ত্র করে দেখিস।”

 কুমু চুপ করে রইল। বিপ্রদাস থাকতে পারলে না, মরিয়া হয়ে বললে, “তোর মনে যদি একটুও খটকা থাকে বিয়ে এখনও ভেঙে দিতে পারি।”

 কুমুদিনী সবেগে মাথা নেড়ে বললে, “ছি ছি, সে কি হয়?”

 অন্তর্যামীর সামনে সত্যগ্রন্থিতে তো গাঁঠ পড়ে গেছে। বাকি যেটুকু সে তো বাইরের।

 বিপ্রদাসের একেলে মন এতটা নিষ্ঠায় অধৈর্য হয়ে ওঠে। সে বললে, “দুই পক্ষের সততায় তবেই বিবাহ-বন্ধন সত্য। সুরে-বাঁধা এসরাজের কোনো মানেই থাকে না যদি বাজাবার হাতটা হয় বেসুরো। পুরাণে দেখ না, যেমন সীতা তেমনি রাম, যেমন মহাদেব তেমনি সতী, অরুন্ধতী যেমন বশিষ্ঠও তেমনি। হাল-আমলের বাবুদের নিজেদের মধ্যে নেই পুণ্য তাই একতরফা সতীত্ব প্রচার করেন। তাঁদের তরফে তেল জোটে না সলতেকে বলেন জ্বলতে—শুকনো প্রাণে জ্বলতে জ্বলতেই ওরা গেল ছাই হয়ে।”

 কুমুকে বলা মিথ্যে। এখন থেকে ও মনে মনে জোরের সঙ্গে জপতে লাগল, তিনি ভালােই হন, মন্দই হন তিনি আমার পরম গতি।

দুঃখেষ্বনুদ্বিগ্নমনা সুখেষু বিগতস্পৃহঃ
বীতরাগভয়ক্রোধঃ—

শুধু যতিধর্মের নয়, সতীধর্মেরও এই লক্ষণ। সে ধর্ম সুখদুঃখের অতীত,—তাতে ক্রোধ নেই, ভয় নেই। আর অনুরাগ? তারই বা অত্যাবশ্যকতা কিসের। অনুরাগে চাওয়া-পাওয়ার হিসেব থাকে, ভক্তি তারও বড়ো। তাতে আবেদন নেই নিবেদন আছে। সতীধর্ম নির্ব্যক্তিক, যাকে ইংরেজিতে বলে ইম্পার্সোনাল। মধুসূদন-ব্যক্তিটিতে দোষ থাকতে পারে, কিন্তু স্বামী নামক ভাব পদার্থটি নির্বিকার নিরঞ্জন। সেই ব্যক্তিকতাহীন ধ্যানরূপের কাছে কুমুদিনী একমনা হয়ে নিজেকে সমর্পণ করে দিলে।