পাতা:বিভূতি রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/২৫৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

তৃণাঙ্কুর ২৩৩ মাঠে সেই বেদেদের তীবুর ছোট গর্তট, সেখানে সেদিনও আকণী ফুলের শোভা দেখতে গিয়েচি–রাজনগরের বটতলাটা সন্ধ্যাবেলায় এক বেড়িয়ে এসেচি আর ভেবেচি এসব জায়গা কত নিরাপদ, কত নিরীহ–হঠাৎ এক সপ্তাহের মধ্যে গালুডির বাংলোর পিছনে বসে লিখচি– রানীঝরনা নেকড়েডুরি সব দেখা হয়েই গেছে। রাখামাইনসে দুরাত্রি যাপন করে এলাম। কিন্তু একটা দেখলাম ব্যাপার। এসব স্থানে সঙ্গী নিয়ে আসতে নেই। একা থাকলে নিজের মন নিয়ে থাকা যায়। তখন নানা অদ্ভুত চিন্তা, অদ্ভূত ভাব এসে মনে জোটে। কিন্তু সঙ্গীরা থাকলে তাদের মন আমাকে চালিত করে—আমার মন তখন আর সাড়া দেয় না, কেমন গভীর অতল তলে লাজুক তার মুখ লুকিয়ে থাকে। কাজেই সঙ্গীদের চিন্তা তখন হয় আমার চিন্তা—সঙ্গীদের ভাব তখন হয় আমার ভাব, আমার নিজস্ব জিনিস সেখানে কিছু থাকে না। কাল মুবর্ণরেখার পারের স্বর্যাস্তের দৃশ্বট, কিংবা গভীর রাত্রের জ্যোৎস্নায় মহুলিয়ার প্রান্তরের ও নেকড়েডুরি পাহাড়ের সে অবাস্তব সৌন্দর্য, একা থাকলে এসব দৃশ্বে আমার মন কত অদ্ভুত কথা বলত—কিন্তু কাল শুধু আডা দেওয়াই এবং চা খাওয়াই হল—মন চাপা পড়ে রইল বটে, অর্থহীন প্রলাপ বকুনির তলায়, সম্মিলিত সিগারেট ধূমের কুয়ালার আড়ালে । তাই বলচি এসব স্থানে আসতে হয় একা। লোক নিয়ে আসতে নেই। অজই এখান থেকে যাব। এখনি বলরাম সায়েরের ঘাটে নেয়ে আসবো—অনেকদিন পরে ওতে বড় আনন্দ পাব। দূরে কালাঝোর পাহাড়, চারিধারে তালের সারি, স্বচ্ছ শীতল জল—দীঘিটা আমার এত ভাল লাগে ! শালবনে নতুন কচি পাতা গজিয়েচে। দূরে কোথায় কোকিল ডাকচে কালাঝোর পাহাড়ের দিকে । এত ভাল লাগচে সকালট ! খুড়োদের ছাদে বসে লিখচি। গ্রীষ্মাবকাশে বাড়ি এসেচি। এবার গালুডতে অনেকদিন থেকে আমার যেন নতুন চোখ খুলেচে, গাছপালার বৈচিত্র্য ও প্রাচুর্য এবার বেশী করে চোখে পড়েচে । সমস্ত প্রাণটা যেন একটা পার্ক-আমার বাড়িতে কোন গাছ থাকুক আর নাই থাকুক, সারা গ্রাম এমন কি কুঠার মাঠ, ইছামতীর দুই তীর, হামল বাশবন—এসবই আমার। আমি দেখি, আমার ভাল লাগে—আমার না তো করি ? প্রায়ই বিকেলে কুঠার মাঠে বেড়াতে যাই, এবার একটা নতুন পথ খুলেচে মাঠের মধ্যে দিয়ে, সেটা আরও অপূর্ব। এমন সবুজ মাঠে, উলুফুল ফুটেচে চারিপারে, শিমুলগাছ হাত বেকিয়ে আছে, দূর বনান্তশীর্ষে বিরাটকায় Lyre পাখীর পুচ্ছের মতে বাশবনের মাথা দুলচে, এমন খামলতা, এমন ঐ—এ আমাদের এই দেশটা ছাড়া আর কোথাও নেই। দুপুরে আজ বেজায় গরম, কাল রাতে ভাল ঘুম হয় নি বলে অভ্যত গরমেও খুব ঘুমুলাম। উঠে দেখি মেঘ করেচে। উত্তর-পশ্চিম কোণে ঘন নীল-কৃষ্ণ কালবৈশাখীর মেঘ,—তারপর উঠল বেজায় ঝড়। আমি আর ঘরে থাকতে পারলাম না, একখানা গামছা নিয়ে তখনি