পাতা:বিভূতি রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড).djvu/২৯৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিভূতি-রচনাবলী নীপু রকে বসিয়া কাদিতেছে। ঘরের মধ্যে গিয়া দেখিল বীণাপাণি তখনও বিছানায় গুইয়া । স্ত্রীকে গায়ে হাত দিয়া ডাকিতে গিয়া দেখিল তাহার গা জরে পুড়িয়া যাইতেছে। সংজ্ঞা নাই—জরের ঘোরে অঘোর অচৈতন্ত । হঠাৎ অনুতাপের দংশনে হরিচরণের মন তীব্র বেদনায় ভরিয়া উঠিল। সেদিন সে-ই সন্ধ্যার সময় গহনা চুরি করিয়াছিল নানাদিকে দেন ও পাওনাদারদের জালায় বিব্রত হইয়া। তাহার পূর্বে কয়েকদিন হইতেই তাহার স্ত্রীর ব্রেসলেট-জোড়াটার উপর লোভ হয়। সেদিন সন্ধ্যাবেল ঘরে ঢুকিয়াই সে দেখিল, দালানের উপর ব্রেসলেটের বাক্স। লোভ সামলাইতে না পারিয়া সেই ব্রেসলেট চুরি করিয়া রামনারায়ণপুরে এক মাড়োয়ারীর দোকানে গিয়া বিক্রয় করিল মোট সাত শত টাকায় । ভাবিয়াছিল, পরে না-হয় একদিন সব প্রকাশ করিবে । স্ত্রীর মাথার কাছে গিয়া ডাকিল—বোঁ, ও বোঁ । বীণাপাণি চোখ মেলিয়া চাহিল। চোখ জবাফুলের মত লাল। হরিচরণ পাগলের মত রামহরি ডাক্তারের বাড়ী ছুটিল। ডাক্তার আসিয়া বলিলেন–জরটা খুব বেশিই হয়েছে, তবে ভয়ের কোনও কারণ নেই। শিশিট পাঠিয়ে দেবেন, ওষুধ দেব। সেইদিন বৈকাল হইতে কিন্তু বীণাপাণির অবস্থা খুব খারাপ হইয়া উঠিল । শেষবেলা হইতেই ছটফট করিতে লাগিল । সন্ধ্যার পর হইতে জরের ঘোরে প্রলাপ বকিতে লাগিল— ওগো, আমায় বললে না কেন ? মুক্তোর মালাছড়াটা তোমায় এমনিই পরিয়ে দিতুম—আমি তো রাখতে চাইনি – ডাক্তার বলিলেন –আজকের রাত আর টিকিবে কিনা সন্দেহ । দশ-বারো বৎসর পরের কথা । 尊 নীপু এখন বড় হইয়াছে। সে বেশ ভাল ছেলে হইয়া উঠিয়াছে। এইবার আই-এ পরীক্ষা দিবে। হরিচরণের দ্বিতীয় পক্ষের বোঁ মেম্বলতা তাহাকে নিজের ছেলের মতই বেশ আদরযত্ন করে। এ পক্ষে হরিচরণের আরও দুই ছেলেমেয়ে হইয়াছে। গ্রামে একখানা ছোট মুদিখানার দোকান করিয়া এখন তাহার একপ্রকার ভালই চলে। শীতের সন্ধ্যায় চুপচাপ বসিয়া তামাক টানিতে টানিতে অনেক সময় তাহার প্রথম পক্ষের স্ত্রীর কথা মনে পড়ে । অনেকদিন আগে রায়াবাড়ীর উঠানে বীণাপাণি একটা ডালিমের চারা পুতিয়াছিল। শীতকালে যখন রাঙা-রাঙা ফলের ভারে গাছটার ডালগুলি জুইয়া পড়ে, তখন ভাত খাইতে খাইতে সেদিকে চাহিয়া হরিচরণের গলায় ভাত বাধিয়া হঠাৎ বিষম লাগিয়া যায়। তাহার ছোট মেয়ে পুটি বলে—ম, তুমি তরকারিতে এত ঝাল দাও কেন ? ঝালের চোটে বাবার চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে !