পাতা:শরৎ সাহিত্য সংগ্রহ (দ্বিতীয় সম্ভার).djvu/১০৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গ্রীকান্ত তোমার মুখে সে কথা শোভা পায় না। বন্ধুর বাপ যখন তোমাদের বোনকেই এক সঙ্গে মাত্র বাহাত্তরটি টাকার লোভে বিয়ে করেছিল, সেদিন এখনো এত পুরানো হয়নি ষে তোমার মনে নেই। তবে নাকি সে লোকটার নেহাৎ পেশ বলেই রক্ষে ; নইলে ধর, যদি সে তোমাকে তার ঘরে নিয়ে যেত, তোমার দুটি একটি ছেলেপূলে হতে —একবার ভেবে দেখ দেখি অবস্থাটা ? রাজলক্ষ্মীর চোখের দৃষ্টিতে কলহ ঘনাইয়া উঠিল, কহিল, ভগবান যাদের পাঠাতেন তাদের তিনিই দেখতেন। তুমি নাস্তিক বলেই কেবল বিশ্বাস কর না। আমিও জবাব দিলাম, আমি নাস্তিক হই, যা হই, আস্তিকের ভগবানের দরকার কি শুধু এই জন্য ?—এই সব ছেলে মানুষ করতে ? রাজলক্ষ্মী ক্রুদ্ধকণ্ঠে কহিল, না হয় তিনি নাই দেখতেন। কিন্তু তোমার মত আমি অত ভীতু নই। আমি দোর দোর ভিক্ষে করেও তাদের মানুষ করতুম। আর যাই হোক, বাইউলী হওয়ার চেয়ে সে আমার ঢের ভাল হ’তো । আমি আর তর্ক করিলাম না। আলোচনাটা নিতান্ত ব্যক্তিগত এবং অপ্রিয় ধারায় নামিয়া আসিয়াছিল বলিয়া জানালার বাহিরে রাস্তার দিকে চাহিয়া নিরুত্তরে বসিয়া রহিলাম । আমাদের গাড়ি ক্রমশঃ সরকারী এবং বেসরকারী অফিস কোয়ার্টার ছাড়াইয়া অনেক দূরে আসিয়া পড়িল। সে দিনটা ছিল শনিবার। বেলা দুটার পর অধিকাংশ অফিসে কেরানী ছুটি পাইয়া আড়াইটার ট্রেন ধরিতে দ্রুতবেগে চলিয়া আসিতেছিল। প্রায় সকলের হাতেই কিছু-না-কিছু খাদ্যসামগ্রী। কাহারও হাতে দুইটা বড় চিংড়ী, কাহারও রুমালে বাধা একটু পাঠার মাংস, কাহারও হাতে পাড়াগায়ের দুষ্প্রাপ্য কিছু কিছু তরি-তরকারি এবং ফলমূল । সাতদিনের পর গৃহে পৌঁছিয়া উংস্থক ছেলেমেয়ের মুখে একটু আনন্দের হাসি দেখিতে প্রায় সকলেই সামর্থ্যমত অল্প-স্বল্প মিষ্টান্ন কিনিয়া চাদরের খুটে বাধিয়া ছুটিতেছে। প্রত্যেকেরই মুখের উপর আনন্দ ও ট্রেন ধরিবার উৎকণ্ঠ একসঙ্গে এমনি পরিস্ফুট হইয়া উঠিয়াছে যে, রাজলক্ষ্মী আমার হাতটা টানিয়া অত্যন্ত কৌতুহলী হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, ই গা, কেন এরা সব এমনভাবে ইস্টশনের দিকে ছুটচেন ? আজ কি ? আমি ফিরিয়া চাহিয়া কহিলাম, আজ শনিবার। এরা সব অফিসের কেরানী, রবিবারের ছুটিতে বাড়ি যাচ্চেন। রাজলক্ষ্মী ঘাড় নাড়িয়া কহিল, ই তাই বটে। আর দেখ, সবাই একটানা-একটা কিছু খাবার জিনিস নিয়ে যাচ্চেন। পাড়াগায়েত এসব পাওয়া যায় না, তাই বোধ হয় ছেলেমেয়েদের হাতে দেবার জন্য কিনে নিয়ে যাচ্চেন, না ? X o X