পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চোখের বালি
২৩

দেখো গে, তোমার নবাবের পুত্র নবাবের ঘর হইতে কী শিক্ষা লইয়া আসিয়াছেন। কর্তারা থাকিলে আজ—”

 অন্নপূর্ণা কাতর হইয়া কহিলেন, “দিদি, তোমার বউকে তুমি শিক্ষা দিবে, শাসন করিবে, আমাকে কেন বলিতেছ।”

 রাজলক্ষ্মী ধনুষ্টংকারের মতো বাজিয়া উঠিলেন, “আমার বউ! তুমি মন্ত্রী থাকিতে সে আমাকে গ্রাহ করিবে!”

 তখন অন্নপূর্ণ সশব্দ পদক্ষেপে দম্পতিকে সচকিত সচেতন করিয়া মহেন্দ্রের শয়নগৃহে উপস্থিত হইলেন। আশাকে কহিলেন, “তুই এমনি করিয়া আমার মাথা হেঁট করিবি, পোড়ারমুখী? লজ্জা নাই, শরম নাই, সময় নাই, অসময় নাই, বৃদ্ধা শাশুড়ির উপর সমস্ত ঘরকন্না চাপাইয়া তুমি এখানে আরাম করিতেছ! আমার পোড়াকপাল, আমি তোমাকে এ ঘরে আনিয়াছিলাম।”

 বলিতে বলিতে তাঁহার চোখ দিয়া জল ঝরিয়া পড়িল, আশাও নতমুখে বস্ত্রাঞ্চল খুঁটিতে খুঁটিতে নিঃশব্দে দাঁড়াইয়া কাঁদিতে লাগিল।

 মহেন্দ্র কহিল, “কাকী, তুমি বউকে কেন অন্যায় ভর্ৎসনা করিতেছ। আমিই তো উহাকে ধরিয়া রাখিয়াছি।”

 অন্নপূর্ণা কহিলেন, “সে কি ভালো কাজ করিয়াছ। ও বালিকা, অনাথ, মার কাছ হইতে কোনোদিন কোনো শিক্ষা পায় নাই, ও ভালোমন্দর কী জানে। তুমি উহাকে কী শিক্ষা দিতে ছ।”

 মহেন্দ্র কহিল, “এই দেখো, উহার জন্যে প্লেট, খাতা, বই কিনিয়া আনিয়াছি। আমি বউকে লেখাপড়া শিখাইব, তা লোকে নিন্দাই করুক আর তোমরা রাগই কর।”

 অন্নপূর্ণা কহিলেন, “তাই কি সমস্ত দিনই শিখাইতে হইবে। সন্ধ্যার পর একআধ ঘণ্টা পড়ালেই তো ঢের হয়।”

 মহেন্দ্র। অত সহজ নয় কাকী, পড়াশুনায় একটু সময়ের দরকার হয়।

 অন্নপূর্ণা বিরক্ত হইয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলেন। আশাও ধীরে ধীরে তাঁহার অনুসরণের উপক্রম করিল; মহেন্দ্র দ্বার রোধ করিয়া দাঁড়াইল, আশার করুণ সজল নেত্রের কাতর অনুনয় মানিল না। কহিল, “রোসো, ঘুমাইয়া সময় নষ্ট করিয়াছি, সেটা পোষাইয়া লইতে হইবে।”

 এমন গম্ভীরপ্রকৃতি শ্রদ্ধেয় মূঢ় থাকিতেও পারেন যিনি মনে করবেন, মহেন্দ্র নিদ্রাবেশে পড়াইবার সময় নষ্ট করিয়াছে। বিশেষরূপে তাঁহাদের অবগতির জন্য