পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৮৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

ইহা অন্যকে আঘাত করিবার জন্য সর্বদাই উগ্রভাবে উদ্যত।

 সেদিন সন্ধ্যায় সকল কথায়, সকল কাজে, আহার করিবার কালে, লীলাকে গল্প বলিবার সময়, ক্রমাগতই সুচরিতার মনের তলদেশে একটা কিসের বেদনা কেবলই পীড়া দিতে লাগিল— তাহা কোনোমতেই সে দূর করিতে পারিল না। কাঁটা কোথায় আছে তাহা জানিতে পারিলে তবে কাঁটা তুলিয়া ফেলিতে পারা যায়। মনের কাঁটাটি খুঁজিয়া বাহির করিবার জন্য সেদিন রাত্রে সুচরিতা সেই গাড়িবারান্দার ছাতে একলা বসিয়া রহিল।

 রাত্রির স্নিগ্ধ অন্ধকার দিয়া সে নিজের মনের অকারণ তাপ যেন মুছিয়া ফেলিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু কোনো ফল হইল না। তাহার বুকের অনির্দেশ্য বোঝাটার জন্য তাহার কাঁদিতে ইচ্ছা করিল, কিন্তু কান্না আসিল না।

 একজন অপরিচিত যুবা কপালে তিলক কাটিয়া আসিয়াছে, অথবা তাহাকে তর্কে পরাস্ত করিয়া তাহার অহংকার নত করা গেল না, এইজন্যই সুচরিতা এতক্ষণ ধরিয়া পীড়া বোধ করিতেছে, ইহার অপেক্ষা অদ্ভুত হাস্যকর কিছুই হইতে পারে না। এই কারণটাকে সম্পূর্ণ অসম্ভব বলিয়া মন হইতে সে বিদায় করিয়া দিল। তখন আসল কারণটা মনে পড়িল এবং মনে পড়িয়া তাহার ভারি লজ্জা বোধ হইল। আজ তিন-চার ঘণ্টা সুচরিতা সেই যুবকের সম্মুখেই বসিয়া ছিল এবং মাঝে মাঝে তাহার পক্ষ অবলম্বন করিয়া তর্কেও যোগ দিয়াছে অথচ সে তাহাকে একেবারে যেন লক্ষ্যমাত্রই করে নাই; যাইবার সময়েও তাহাকে সে যেন চোখে দেখিতেই পাইল না। এই পরিপূর্ণ উপেক্ষাই যে সুচরিতাকে গভীর ভাবে বিঁধিয়াছে তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই। বাহিরের মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশার অনভ্যাস থাকিলে যে-একটা সংকোচ জন্মে, বিনয়ের ব্যবহারে যে-একটি সংকোচের পরিচয় পাওয়া যায়— সেই সংকোচের মধ্যে একটা সলজ্জ নম্রতা আছে। গোরার আচরণে তাহার চিহ্নমাত্রও ছিল না। তাহার সেই কঠোর এবং প্রবল ঔদাসীন্য সহ্য করা বা তাহাকে অবজ্ঞা করিয়া উড়াইয়া দেওয়া সুচরিতার পক্ষে আজ কেন এমন অসম্ভব হইয়া উঠিল। এতবড়ো উপেক্ষার সম্মুখেও সে যে আত্মসম্বরণ

৭৫