পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪১০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

তুমি বসে থেকে দেখবে? দেশের লোকের হিঁদুয়ানি রক্ষার জন্যে তোমার আহারনিদ্রা বন্ধ, এ দিকে নিজের পরম বন্ধুই যদি জাত ভাসিয়ে দিয়ে ব্রাহ্মর ঘরে বিয়ে করে বসে তা হলে মানুষের কাছে যে মুখ দেখাতে পারবে না। বিনয়, তুমি বোধ হয় রাগ করছ, কিন্তু ঢের লোক তোমার অসাক্ষাতেই এই-সব কথা গোরাকে বলত- তারা বলবার জন্যে ছট্‌ফট্‌ করছে আমি সামনেই বলে গেলুম- তাতে সকল পক্ষে ভালোই হবে। গুজবটা যদি মিথ্যাই হয় তা হলে সে কথা বললেই চুকে যাবে, যদি সত্যি হয় তা হলে বোঝাপড়া করে নাও।”

 মহিম উঠিয়া চলিয়া গেলেন, বিনয় তখনো কোনো কথা কহিল না। গোরা জিজ্ঞাসা করিল, “কী বিনয়, ব্যাপারটা কী?”

 বিনয় কহিল, “শুধু কেবল গোটাকতক খবর দিয়ে অবস্থাটা ঠিক বোঝানো ভারি শক্ত; তাই মনে করেছিলুম, আস্তে আস্তে তোমাকে সমস্ত ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলব। কিন্তু, পৃথিবীতে আমাদের সুবিধামত ধীরেসুস্থে কিছুই ঘটতে চায় না; ঘটনাগুলোও শিকারি বাঘের মতো প্রথমটা গুড়ি মেরে মেরে নিঃশব্দে চলে, তার পরে হঠাৎ এক সময় ঘাড়ের উপর লাফ দিয়ে এসে পড়ে; আবার তার সংবাদও আগুনের মতো প্রথমটা চাপা থাকে, তার পরে হঠাৎ দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে, তখন তাকে আর সামলানো যায় না। সেইজন্যেই এক-এক সময় মনে হয়, কর্মমাত্রই ত্যাগ করে একেবারে স্থাণু হয়ে বসে থাকাই মানুষের পক্ষে মুক্তি।”

 গোরা হাসিয়া কহিল, “তুমি একলা স্থাণু হয়ে বসে থাকলেই বা মুক্তি কোথায়? সেই সঙ্গে জগৎসুদ্ধ যদি স্থাণু হয়ে না ওঠে তা হলে তোমাকে স্থির থাকতে দেবে কেন? সে আরও উল্‌টো বিপদ হবে। জগৎ যখন কাজ করছে তখন তুমিও যদি কাজ না কর তা হলে যে কেবলই ঠকবে। সেইজন্যে এইটে দেখতে হবে, ঘটনা যেন তোমার সতর্কতাকে ডিঙিয়ে যায়- এটা না হয় যে, আর-সমস্তই চলছে কেবল তুমিই প্রস্তুত নেই।”

 বিনয় কহিল, “ওই কথাটাই ঠিক। আমিই প্রস্তুত থাকি নে।

৪০০