পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩৯২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

আমার কেবল শেষ বলবার কথাটি এই, আপনাকে এখন দূরে থাকতে হবে। নইলে অত্যন্ত অন্যায় হবে। আপনারা পরেশবাবুর পরিবারের মধ্যে প্রবেশ করে কেবল একটা অশান্তির সৃষ্টি করে তুলেছেন, তাঁদের মধ্যে কী অনিষ্ট বিস্তার করেছেন তা আপনারা জানেন না।”

 হারানবাবু চলিয়া গেলে বিনয়ের মনের মধ্যে একটা বেদনা শূলের মতো বিঁধিতে লাগিল। সরলহৃদয় উদারচিত্ত পরেশবাবু কত সমাদরের সহিত তাহাদের দুইজনকে তাঁহার ঘরের মধ্যে ডাকিয়া লইয়াছিলেন— বিনয় হয়তো না বুঝিয়া এই ব্রাহ্ম-পরিবারের মধ্যে আপন অধিকারের সীমা পদে পদে লঙ্ঘন করিতেছিল, তবু তাঁহার স্নেহ ও শ্রদ্ধা হইতে সে একদিনও বঞ্চিত হয় নাই; এই পরিবারের মধ্যে বিনয়ের প্রকৃতি এমন একটি গভীরতর আশ্রয় লাভ করিয়াছে যেমনটি সে আর-কোথাও পায় নাই। উঁহাদের সঙ্গে পরিচয়ের পর বিনয় যেন নিজের একটি বিশেষ সত্তাকে উপলব্ধি করিয়াছে। এই-যে এত আদর, এত আনন্দ, এমন আশ্রয় যেখানে পাইয়াছে সেই পরিবারে বিনয়ের স্মৃতি চিরদিন কাঁটার মতো বিঁধিয়া থাকিবে! পরেশবাবুর মেয়েদের উপর সে একটা অপমানের কালিমা আনিয়া দিল! ললিতার সমস্ত ভবিষ্যৎ জীবনের উপরে সে এত বড়ো একটা লাঞ্ছনা আঁকিয়া দিল! ইহার কী প্রতীকার হইতে পারে! হায় রে হায়, সমাজ বলিয়া জিনিসটা সত্যের মধ্যে কত বড়ো একটা বিরোধ জাগাইয়া তুলিয়াছে! ললিতার সঙ্গে বিনয়ের মিলনের কোনো সত্য বাধা নাই; ললিতার সুখ ও মঙ্গলের জন্য বিনয় নিজের সমস্ত জীবন উৎসর্গ করিয়া দিতে কিরূপ প্রস্তুত আছে তাহা সেই দেবতাই জানেন যিনি উভয়ের অন্তর্যামী— তিনিই তো বিনয়কে প্রেমের আকর্ষণে ললিতার এত নিকটে আনিয়া দিয়াছেন— তাঁহার শাশ্বত ধর্মবিধিতে তো কোথাও বাধে নাই। তবে ব্রাহ্মসমাজের যে দেবতাকে পানুবাবুর মতো লোকে পূজা করেন তিনি কি আর-এক জন কেহ? তিনি কি মানবচিত্তের অন্তরতর বিধাতা নন? ললিতার সঙ্গে তাহার মিলনের

৩৮২