পাতা:প্রবাসী (দ্বাত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৮৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বৈশাখ চূড়ান্ত যুক্তি কিছু যেন আরও ছিল। নরেন্দ্রের গলা কঁপিয়া গেল। বলিলেন, “কিন্তু ফিরে আস্বার কথা যদি কখনও তোমার মনে হয়, এ বাড়ির দরজা চিরদিন তোমার জন্যে খোলাই থাকবে।” হেমবালা অত্যন্ত মৃদুস্বরে কি বলিলেন তাহ শোনা গেল না । “এই তাহলে শেষ ?” “তুমি জান। আমি অনেক আগেই শেষ করেছি।” “ঐন্দ্রিল ?” “সে আমার কাছেই থাকবে ।” “সে যদি আমাকে ক্ষমা করে ?” “আমি বাধা দেব না, কিন্তু তার ওপর আমার শাসন যতদিন চলবে, আমার কাছেই তাকে রাখব।” “বাপকে দেখতে আসাও তার বারণ ?” “আমি বারণই করব ।” নরেন্দ্র দাড়াইয়াছিলেন, ফিরিয়া গিয়া থাটের একদিক্‌টায় বসিলেন । হাসিবার চেষ্টা করিয়া কহিলেন, “তুমি জান এইখানটায় আমার জবরদস্তি চলে ?” হেমবালা এবার চকিতে একবার স্বামীর দিকে ফিরিয়া চাহিলেন । তারপর কহিলেন, “জবরদস্তি আরও অনেক জায়গায় তোমার হয়ত চলে, কিন্তু খুব একটা লোক-জানাজানি হলে তাতে তোমার কিছু লাভ হবে ? ইলু এখন অবধি কিছু জানে না, যখন জানবে তোমার প্রতি তার প্রতি কিছুমাত্র বাড়বে না।” মুদ্রিতচক্ষে নরেন্দ্র দুই ভুরুর মাঝখানটা অঙিলে চাপিতে লাগিলেন । বলিবার বা শুনিবার আর কোনো কথাই অবশিষ্ট নাই। বাহির হইয়া যাইবার আগে নিত্যকার মত স্বাভাবিক গলা করিবার প্রাণপণ চেষ্টা করিয়া কহিলেন, “যাবার ব্যবস্থা সব ঠিক হয়েছে ?” “দেওয়ানজীকে বলেছি, এতক্ষণ হয়ে গিয়ে থাকৃবে।” # «ساتffچBr، “আমার হাতে যা আছে তাই যথেষ্ট । ইলুকে পড়াখরচ ব’লে কলকাতায় যা পাঠানো হত সেটা অবশ্ব যাবে।” "নাসিরগঞ্জ অবধি তোমাদের পৌছে দিয়ে আসব ?” “দরকার হবে না।” শৃঙ্খল ዓ¢ ধীরপদে নতমস্তকে নরেন্দ্র বাহির হইয়া গেলেন। কঠিন পরীক্ষায় এত সহজে উত্তীর্ণ হইবেন, হেমবালা বুঝিতে পারেন নাই। মনে মনে অনেক কঠিন কথার মহড়া দিয়া রাখিয়াছিলেন, তেমন করিয়া কিছু বলা হইল না বলিয়া কোথায় যেন একটু ক্ষোভও রহিয়া গেল। উত্তেজিত হইয়াছিলেন, জিনিস গোছানোর কাজ অসমাপ্ত ফেলিয়া রাখিয়া ঐন্দ্রিলার সংবাদ লইতে প্রস্থান করিলেন। নিজের ঘরে গোটা-দুই খোলা সুটকেসের সামনে মাদুরের উপর ঐন্দ্রিলা বসিয়াছিল । মায়ের সাড়া পাইয়া তাড়াতাড়ি আঁচলে চোখ মুছিয়া ফিরিয়া তাকাইল । ছুটির পর বাড়ী ছাড়িয়া যাইতে ঐন্দ্রিল চিরকালই অত্যস্ত দুঃখ পায়,কিন্তু কান্নাকাটি করা তাহার স্বভাবে নাই । নিজের কোনও দুৰ্ব্বলতাকে কোথাও প্রকাশ হইতে দিতে অতি শৈশব হইতে তাহার ঘোরতর আপত্তি। আজ তাই তাহার অশ্রশ্লাবিত চোখের দিকে চাহিয়৷ হেমবালার মনে হঠাৎ একটা বড়রকম দোলা লাগিল।--হেমবালার সহসা মনে পড়িল, মনে মনে এতদিন ঐন্দ্রিলাকে অকারণেই তিনি অপরিণতবুদ্ধি বালিকা কল্পনা করিয়া আসিয়াছেন। বাল্যের সীমা বহুকাল তার উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে। বালিকা বয়সেই কলিকাতায় মামার কাছে থাকিয়া সে পড়িতে গিয়াছিল। তাহাদের একমাত্র সস্তান বলিয়, দেশাচারবিরুদ্ধ হইলেও তাহাকে পুত্রস্থানীয় করিয়া মানুষ করিবার এই ব্যবস্থাতে নরেন্দ্রনারায়ণ বাধা দেন নাই, উৎসাহের সঙ্গেই রাজি হইয়াছিলেন। তাহার পর হইতে প্রতি বৎসর কখনও দুইবার, কখনও বা তিনবার দেশে পিতামাতার কাছে ঐন্দ্রিলা ছুটি কাটাইতে আসিয়াছে ; স্বল্পস্থায়ী সেই মিলনোৎসবের দিনগুলিতে তাহার গভীরতর মনের কোনও পরিচয় লইবার স্বযোগ হেমবালার হয় নাই । যে-বয়সে সে মায়ের কোল ছাড়িয়া দূরে গিয়াছিল, মায়ের স্নেহান্ধ দৃষ্টিতে সেই বয়সটাই তাহার চিরস্তন হইয়া রহিয়া গিয়াছে । আজ ঐন্দ্রিলার চোখের দৃষ্টির মধ্যে তাকাইয়া হেমবালা হঠাৎ অমুভব করিলেন, কত বড় ভুল এতদিন তিনি করিয়াছেন। বুঝিলেন, এ আর বালিকা নহে, ইহার পরিণত মনের নিকট হইতে কোনও কথা লুকাইবার শুষ্ট করা: