পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩১৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি ২৯৭ . মা তাহার উদ্দীপ্ত জালা দমন করিয়া অত্যন্ত তীক্ষ ধীর ভাবে কহিলেন, “র্তাহাকে লইয়া কী করিতে হইবে ।” মহেন্দ্র কহিল, “তাহাকে আমি লেখাপড়া শিখাইব ।” রাজলক্ষ্মী কিছু না কহিয়া দ্রুতপদে চলিয়া গেলেন ও মুহূর্তপরে বধূর হাত ধরিয়া টানিয়া লইয়া মহেন্দ্রের সম্মুখে স্থাপিত করিয়া কহিলেন, “এই লও, তোমার বধূকে তুমি লেখাপড়া শেখাও।” এই বলিয়া অন্নপূর্ণার দিকে ফিরিয়া গলবস্ত্র-জোড়করে কহিলেন, “মাপ করে। মেজগিরি, মাপ করে । তোমার বোনঝির মর্যাদা আমি বুঝিতে পারি নাই ; উহার কোমল হাতে আমি হলুদের দাগ লাগাইয়াছি, এখন তুমি উহাকে ধুইয়া মুছিয়া বিবি সাজাইয়া মহিনের হাতে দাও— উনি পায়ের উপর পা দিয়া লেখাপড়া শিখুন, দাসীবৃত্তি আমি করিব।” এই বলিয়া রাজলক্ষ্মী নিজের ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া সশব্দে অর্গল বন্ধ করিলেন। অন্নপূর্ণ ক্ষোভে মাটির উপর বসিয়া পড়িলেন। আশা এই আকস্মিক গৃহবিপ্লবের কোনো তাৎপর্য না বুঝিয়া লজ্জায় ভয়ে দুঃখে বিবর্ণ হইয়া গেল। মহেন্দ্র অত্যন্ত রাগিয়া মনে মনে কহিল, “আর নয়, নিজের স্ত্রীর ভার নিজের হাতে লইতেই হইবে, নহিলে অন্যায় হইবে।” - - ইচ্ছার সহিত কর্তব্যবুদ্ধি মিলিত হইতেই হাওয়ার সঙ্গে আগুন লাগিয়া গেল । কোথায় গেল কালেজ, এক্জামিন, বন্ধুকৃত্য, সামাজিকতা ; স্ত্রীর উন্নতি সাধন করিতে মহেন্দ্র তাহাকে লইয়া ঘরে ঢুকিল— কাজের প্রতি দৃকপাত বা লোকের প্রতি ভ্ৰক্ষেপমাত্রও করিল না। অভিমানিনী রাজলক্ষ্মী মনে মনে কহিলেন, “মহেন্দ্র যদি এখন তার বউকে লইয়া আমার দ্বারে হত্যা দিয়া পড়ে, তবু আমি তাকাইব না, দেখি সে তার মাকে বাদ দিয়া স্ত্রীকে লইয়া কেমন করিয়া কাটায়।” দিন যায়— দ্বারের কাছে কোনো অমৃতপ্তের পদশবদ শুনা গেল না । রাজলক্ষ্মী স্থির করিলেন, ক্ষমা চাহিতে আসিলে ক্ষমা করিবেন— নহিলে মহেন্দ্রকে অত্যন্ত ব্যথা দেওয়া হইবে। ক্ষমার আবেদন আসিয়া পৌছিল না। তখন রাজলক্ষ্মী স্থির করিলেন, তিনি নিজে গিয়াই ক্ষমা করিয়া আসিবেন । ছেলে অভিমান করিয়া আছে বলিয়া কি মাও অভিমান করিয়া থাকিবে। তেতলার ছাদের এক কোণে একটি ক্ষুদ্র গৃহে মহেন্দ্রের শয়ন এবং অধ্যয়নের