পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩২৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী ولاo (ك আমার হৃদয় ভাঙিয়া যাওয়া উচিত, তাই সে আজ খুব সমারোহ করিয়া হৃদয় ভাঙিতে বসিয়াছে। নভেল-পড়া কয়জন মেয়ের ভাগ্যে ভালোবাসার নৈরাপ্ত সহিবার এমন চমৎকার স্বযোগ ঘটে ! যোগেন্দ্রের কঠিন বিদ্রুপ হইতে কন্যাকে বাচাইবার জন্য অন্নদাবাবু তাড়াতাড়ি বলিলেন, “আমি হেমকে লইয়া একটুখানি গল্প করিতেছি।” যেন তিনিই গল্প করিবার জন্য হেমকে ছাদে টানিয়া আনিয়াছেন । যোগেন্দ্ৰ কহিল, “কেন, চায়ের টেবিলে কি আর গল্প হয় না ? বাবা, তুমি-স্বদ্ধ হেমকে খেপাইবার চেষ্টায় আছ । এমন করিলে তো বাড়িতে টেকা দায় হয় ।” হেমনলিনী চকিত হইয়া কহিল, “বাবা, এখনো কি তোমার চা খাওয়া হয় নাই ?” যোগেন্দ্র । চা তো কবিকল্পনা নয় যে, সন্ধ্যাবেলাকার আকাশের স্বর্যাস্ত-আভা হইতে আপনি ঝরিয়া পড়িবে । ছাদের কোণে বসিয়া থাকিলে চায়ের পেয়াল ভরিয়া উঠে না, এ কথাও কি নূতন করিয়া বলিয়া দিতে হইবে ? অন্নদ। হেমনলিনীর লজ্জানিবারণের জন্য তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিলেন, “আমি যে অাজ চা খাইব না বলিয়া ঠিক করিয়াছি।” যোগেন্দ্র । কেন বাবা, তোমরা সকলেই তপস্বী হইয়া উঠিবে নাকি ? তাহা হইলে আমার দশা কী হইবে বায়ু-আহারটা আমার সহ হয় না । অন্নদা। না না, তপস্তার কথা হইতেছে না ; কাল রাত্রে আমার ভালো ঘুম হয় নাই, তাই ভাবিতেছিলাম আজ চা ন খাইয় দেখা যাক কেমন থাকি । বস্তুত হেমনলিনীর সঙ্গে কথা কহিবার সময় পরিপূর্ণ চায়ের পেয়ালার ধ্যানমূর্তি অনেক বার অন্নদাবাবুকে প্রলুব্ধ করিয়া গেছে, কিন্তু আজ উঠিতে পারেন নাই । অনেক দিন পরে আজ হেম তাহার সঙ্গে সুস্থ ভাবে কথা কহিতেছে, এই নিভৃত ছাদে দুটিতে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ আলাপ জমিয়া উঠিয়াছে, এমন গভীর-নিবিড়-ভাবে আলাপ পূর্বে তো তাহার কখনো মনে পড়ে না। এ আলাপ এক জায়গা হইতে আর এক জায়গায় তুলিয়া লইয়া যাওয়া সহিবে না— নড়িবার চেষ্টা করিলেই ভীরু হরিণের মতো সমস্ত জিনিস ছুটিয়া পালাইবে। সেইজন্যই অন্নদাবাবু আজ চা-পায়ের মুহুর্মহ জাহান উপেক্ষা করিয়াছিলেন । অন্নদাবাবু যে চা-পান রহিত করিয়া অনিদ্রার চিকিৎসায় প্রবৃত্ত হইয়াছেন, এ কথা হেমনলিনী বিশ্বাস করিল না ; সে কহিল, “চলে বাবা, চা থাইবে চলো।” অন্নদাবাবু সেই মুহূর্তেই অনিদ্রার আশঙ্কাটা বিস্তৃত হইয়া ব্যগ্রপদেই টেবিলের অভিমুখে ধাবিত হইলেন।