পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/১২০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৯৫

কিন্তু বাংলাদেশ একটা অনিশ্চিত ব্যাপার। কারো কারো ধারণা, বাংলাদেশকে নিয়ে ভারত যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে ভারতের অগ্রগতি ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যাহত হতে পারে।

 এ সময় দিল্লীতে শেখ আবদুল্লার সাথেও আমার দেখা হয়। একটি বাড়ীতে আধা নজরবন্দী অবস্থায় তিনি থাকতেন। তাঁর চলাফেরার ওপর বিভিন্ন সংস্থার কড়া নজর ছিল। তাঁর মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে তখন তিনি ব্যস্ত ছিলেন। তবুও পুরো ১টা দিন তিনি আমার জন্য ব্যয় করেন।

 বহু দিন পূর্ব থেকেই তাঁর নাম শুনেছি। কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। আমার চোখে তিনি বীর। ভারতের উত্থান পতনের ইতিহাসে তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তিনি স্পষ্টবাদী। তিনি তার মনোভাব গোপন করলেন না। তিনি বললেন, তিনি পাকিস্তান চাননি। কিন্তু বাঙ্গালীরা তা চেয়েছিল। তারা আবার আজকে বাংলাদেশ চায়। আগামীতে তারা আবার কি চাইবে, তার কোন নিশ্চয়তা আছে কি? শেখ আবদুল্লাহর কথাগুলো তখন আমার খুব ভালো লাগেনি। কিন্তু তার কথার ভেতরে যে ইঙ্গিত ছিল, পরে তার মর্ম বেশী করে উপলদ্ধি করেছি।

 আমি শেখকে বুঝাবার চেষ্টা করি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাঙ্গালী আজ সম্পূর্ণভাবে ঐক্যবদ্ধ। আমাদের সংগ্রাম ৮ কোটি বাঙ্গালীর অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের কথা বলতেই তিনি আবার ক্ষুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, তোমরা জিন্নাহর পেছনেও ছিলে। নাচাটাই তোমাদের স্বভাব। আজ তোমরা বঙ্গবন্ধুর পেছনে আছো। আবার কালকে তাঁর বিরোধিতা করতেও তোমাদের সময় লাগবে না। কাজেই তোমাদের প্রতি অন্ততঃ আমার কোন সমর্থন নেই।

 সে সময় পাকিস্তানের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করছে এমন কিছু ব্যাক্তির সাথেও আমি সাক্ষাৎ করি। তখন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ভারতীয় সংসদে একটি প্রতিনিধিদলও প্রেরণ করা হয়। মিঃ ফণীভূষণ মজুমদারের নেতৃত্বাধীন এই প্রতিনিধিদলের অন্যান্য সদস্য ছিলেন মিসেস নূরজাহান মোর্শেদ এবং শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন।

 আমি দিল্লী আসার আগেই বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল ভারতীয় সংসদে বক্তৃতা করেন। আমি দিল্লী এসেছি জেনে তারা আমার সাথেও যোগাযোগ করেন। বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল আহূত সাংবাদিক সম্মেলনে থাকার জন্যে আমাকে অনুরোধ করা হলো। সম্মেলনে পেশ করার জন্য বক্তব্য তৈরী করে নিয়ে গেলাম। ফনীদা জানতেন বিদেশী প্রেসের সাথে আমি যোগাযোগ রক্ষা করছি। দিল্লী প্রেসক্লাবে তিনি আমাকে সামনে ঠেলে দিলেন। সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দিলাম। সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে প্রশ্ন আহ্বান করি। শাহ মোয়াজ্জেম আমার নাম বলে পরিচয় করিয়ে দিলেন। কিন্তু তখনো আমি ছদ্মনাম ‘রহমত আলী’ হিসেবে পরিচিত। ভারতীয় পত্রপত্রিকায় আমার বক্তব্য প্রচারিত হলো। পরিবার পরিজনের সাথে তখনো আমার দেখা হয়নি।

 সাংবাদিকদের প্রশ্নের মূল বক্তব্য ছিল পাক হানাদার বাহিনীর মোকাবিলায় অনভিজ্ঞ গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা কিভাবে সফল হবেন এবং যুদ্ধের প্রকৃত অবস্থাই বা কি? উত্তরে বললাম, দেশ মাতৃকার জন্য রক্তদানে প্রস্তুত বাংলার মুক্তিযোদ্ধারা ভাড়াটে পাক হানাদার বাহিনীকে পরাভূত করবেই। আমাদের ধরণা ছিল বর্ষাকালে পাক বাহিনীর অগ্রযাত্রা ব্যাহত হবে। প্লাবন ও বন্যায় অনভ্যস্ত পশ্চিমা বাহিনী এ সময় মূলতঃ শহরে আটক থাকবে। আমাদের যুদ্ধ পরিকল্পনাও তেমনি ছিল। সাংবাদিক সম্মেলনে এরূপ ইঙ্গিত দেই। কিন্তু বাস্তবে ঘটনা অন্যরূপ। পাক হানাদার বাহিনী গান বোটের সাহয্যে প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রবেশ করে মুক্তিবাহিনীর ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে।

 দিল্লী থাকাকালে অন্য একটি কাজ করি। সিপিআই-এর একজন এমপি’র মাধ্যমে দিল্লীস্থ সোভিয়েত দূতাবাসের সাথে যোগাযোগ হয়। সংসদীয় দলের ৩ জন প্রতিনিধিসহ ৪জন সোভিয়েত দূতাবাসে যাই।