সতী/১১

উইকিসংকলন থেকে
(পৃ. ৫২-৫৪)
◄  ১০
১২  ►
১১

 মহাবাত্যার পর প্রশান্ত প্রকৃতির ন্যায় শিব বিল্বমূলে বসিয়াছিলেন। তিনি সতীর চিন্তা পরিহারপূর্ব্বক ধ্যান-নিমগ্ন ছিলেন। সেই যোগানন্দ উদয়ের সঙ্গে তদীয় বিম্বাধরে পুনরায় প্রশান্ত উদাসীনের হাস্য-রেখা অঙ্কিত হইতেছিল।

 ব্রহ্মার কমণ্ডলু ও বিষ্ণুর চক্র যুগপৎ তাঁহার পদস্পর্শ করাতে তদীয় ধ্যান ভঙ্গ হইল, তখন সতীর জন্য হৃদয়ে দারুণ জ্বালা অনুভব করিলেন। তিনি ব্রহ্মা ও বিষ্ণুকে দেখিয়া বলিলেন, “দক্ষের জন্য আপনারা আসিয়াছেন, আমি নন্দীর আর্ত্তনাদে মুহূর্ত্তকাল আত্মবিস্মৃত হইয়া ক্রুদ্ধ হইয়াছিলাম, তখন কি হইয়াছে জানি না। যদি দক্ষ বিনষ্ট হইয়া থাকেন, তাহা জগতের ইষ্টের জন্য। দক্ষ আমাকে প্রত্যাখ্যান করিয়া জগতের সমস্ত বৈভব-বিতৃষ্ণ মুমুক্ষু ব্যক্তিকে প্রত্যাখ্যান করিয়াছেন। যাঁহারা দৈহিক সুখের পক্ষপাতী নহেন, বিশ্ব-স্থিত যাঁহাদের মূলমন্ত্র, এমন সকল ঋষি যজ্ঞে উপস্থিত হন নাই। দক্ষ আমাকে ত্যাগ করিয়া তাঁহাদিগকে প্রত্যাখ্যান করিয়াছেন। যে বাহ্যদারিদ্র্য না হইলে চিত্তের শ্রীবৃদ্ধি হয় না, আমাকে প্রত্যাখ্যান করিয়া সেই দারিদ্র্যের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করিয়াছেন। আর স্ত্রীলোকের যে একনিষ্ঠ প্রেম-যোগ, সতীর মৃত্যুতে দক্ষের হস্তে তাহারই অবমাননা সূচিত হইতেছে। বিশ্বের মঙ্গল-দ্রোহী এরূপ দাম্ভিকের প্রভুত্ব ধরিত্রী সহ্য করিতে পারেন নাই।”

 দেবগণ বলিলেন, “হে মঙ্গল-আলয়! জগতের ইষ্টের বিঘ্ন না হইলে রুদ্রের রৌদ্র ভাব বিকাশ পায় না, বিশ্বের প্রয়োজনেই স্বয়ম্ভুর রুদ্রত্ব উপস্থিত হইয়া থাকে। এখন ভগবন্‌! একবার স্বচক্ষে যজ্ঞশালা দেখিয়া আসুন, কাঞ্চনপ্রতিমা সতী যজ্ঞকুণ্ডের পার্শ্বে পড়িয়া আছেন, একবার সেই চিত্রখানি দেখুন।”

 মহাদেব সতীর নাম শুনিয়া একটি দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিলেন, কৈলাসের সমস্ত তরুর ফুল সেই নিশ্বাসে শুকাইয়া গেল।

 সতীর অবস্থা দেখিবার জন্য ভোলানাথ বিষ্ণু ও ব্রহ্মার সঙ্গে সেই যজ্ঞশালায় উপস্থিত হইলেন। দেখিলেন, যজ্ঞস্থলী রণস্থলীর ন্যায় বীভৎস-দর্শন হইয়াছে। দক্ষের মুণ্ড ও শরীর পৃথক্‌ হইয়াছে, ঋষিগণ দারুণ প্রহারে রক্তাক্তদেহে মূর্চ্ছিত হইয়া আছেন—হোমানলে রক্ত পুড়িয়া দুর্গন্ধ হইয়াছে, অন্তঃপুরে হাহাকার উঠিয়াছে। নন্দী চীৎকার করিয়া মা’ মা’ বলিয়া কাঁদিতেছে ও বীরভদ্র, চণ্ডেশ প্রভৃতি শিবসহচরগণ যজ্ঞধ্বংস করিয়া রোষকষায়িত নেত্রে বসিয়া আছে। আর দেখিলেন, বেদী হইতে একটু দূরে সতীর দেহ ভূতলে পড়িয়া আছে। বিদায়কালে যে জবাটি তাঁহার কেশপাশে লগ্ন ছিল, তাহা ঠিক সেইরূপই আছে। বল্কলবাস ত্রস্ত হইয়া জানুর উপর আকুঞ্চিত হইয়া আছে। দেহের বিভূতির সঙ্গে যজ্ঞের ভস্ম মিশিয়া গিয়াছে, রুদ্রাক্ষের হার ছিঁড়িয়া গিয়াছে, একটি রুদ্রাক্ষ কণ্ঠের নিকট গড়াইয়া পড়িয়াছে—আর সতী শিবের সৌগন্ধিক বনে কর্ণিকার ও স্থলপদ্মের সন্ধানে যাইবেন না! শিব ত্রিনেত্র বিস্তারিত করিয়া সাধ্বীর সেই মূর্ত্তি অবলোকন করিলেন।

 তাঁহার কোন ক্রোধ হইল না, যজ্ঞাগারে নিহত ব্যক্তিগণ তাঁহার বরে বাঁচিয়া উঠিল। দাম্ভিক দক্ষের শিক্ষার জন্য তাঁহার ছাগমুণ্ড হইল! সেই স্থানে যজ্ঞেশ্বর হরি স্বয়ং সেই যজ্ঞের পূর্ণাহুতি প্রদান করিলেন; দক্ষ যজ্ঞের সমস্ত অবশিষ্ট ভাগ শিবকে প্রদান করিয়া তাঁহাকে স্তুতি করিলে আশুতোষ প্রসন্ন হইলেন।