শেষের কবিতা/ঘটকালি
৭
ঘটকালি
অমিত যোগমায়ার কাছে এসে বললে, ‘মাসিমা, ঘটকালি করতে এলেম। বিদায়ের বেলা কৃপণতা করবেন না।’
‘পছন্দ হলে তবে তো? আগে নাম ধাম বিবরণটা বলো।’
অমিত বললে, ‘নাম নিয়ে পাত্রটির দাম নয়।’
‘তা হলে ঘটক-বিদায়ের হিসাব থেকে কিছু বাদ পড়বে দেখছি।’
অন্যায় কথা বললেন। নাম যার বড়ো তার সংসারটা ঘরে অল্প, বাইরেই বেশি। ঘরের মন-রক্ষার চেয়ে বাইরে মান-রক্ষাতেই তার যত সময় যায়। মানুষটার অতি অল্প অংশই পড়ে স্ত্রীর ভাগে, পুরো বিবাহের পক্ষে সেটুকু যথেষ্ট নয়। নাম- জাদা মানুষের বিবাহ স্বল্পবিবাহ, বহুবিবাহের মতোই গর্হিত।’
‘আচ্ছা, নামটা নাহয় খাটো হল, রূপটা?’
‘বলতে ইচ্ছে করি নে, পাছে অত্যুক্তি করে বসি।’
‘অত্যুক্তির জোরেই বুঝি বাজারে চালাতে হবে?’
‘পাত্র-বাছাইয়ের বেলায় দুটি জিনিস লক্ষ করা চাই— নামের দ্বারা বর যেন ঘরকে ছাড়িয়ে না যায়, আর রূপের দ্বারা কনেকে।’
‘আচ্ছা, নামরূপ থাক, বাকিটা?’
‘বাকি যেটা রইল সব জড়িয়ে সেটাকে বলে পদার্থ। তা, লোকটা অপদার্থ নয়।’ ‘বুদ্ধি?’
‘লোকে যাতে ওকে বুদ্ধিমান ব'লে হঠাৎ ভ্রম করে সেটুকু বুদ্ধি ওর আছে।'
'বিদ্যে?'
‘স্বয়ং নিউটনের মতো। ও জানে যে, জ্ঞানসমুদ্রের কূলে সে নুড়ি কুড়িয়েছে মাত্র। তার মতো সাহস করে বলতে পারে না, পাছে লোকে ফস করে বিশ্বাস করে বসে।'
‘পাত্রের যোগ্যতার ফর্দটা তো দেখছি কিছু খাটো গোছের।’
‘অন্নপূর্ণার পূর্ণতা প্রকাশ করতে হবে বলেই শিব নিজেকে ভিখারি কবুল করেন, একটুও লজ্জা নেই।’
‘তা হলে পরিচয়টা আরো একটু স্পষ্ট করো।'
'জানা ঘর। পাত্রটির নাম অমিতকুমার রায়। হাসছেন কেন মাসিমা? ভাবছেন কথাটা ঠাট্টা?'
‘সে ভয় মনে আছে বাবা, পাছে শেষ পর্যন্ত ঠাট্টাই হয়ে ওঠে।'
'এ সন্দেহটা পাত্রের পরে দোষারোপ।'
‘বাবা, সংসারটাকে হেসে হালকা করে রাখা কম ক্ষমতা নয়।’
‘মাসি, দেবতাদের সেই ক্ষমতা আছে, তাই দেবতারা বিবাহের অযোগ্য; দময়ন্তী সে কথা বুঝেছিলেন।'
‘আমার লাবণ্যকে সত্যি কি তোমার পছন্দ হয়েছে?’
‘কিরকম পরীক্ষা চান বলুন।’
‘একমাত্র পরীক্ষা হচ্ছে, লাবণ্য যে তোমার হাতেই আছে, এইটি তোমার নিশ্চিত জানা!' 'কথাটাকে আর-একটু ব্যাখ্যা করুন।'
‘যে রত্নকে সস্তায় পাওয়া গেল তারও আসল মূল্য যে বোঝে সেই জানব জহুরি।'
‘মাসিমা, কথাটাকে বড় বেশি সূক্ষ্ম করে তুলছেন। মনে হচ্ছে, যেন একটা ছোটো গল্পের সাইকোলজিতে শান লাগিয়েছেন। কিন্তু কথাটা আসলে মোটা, জাগতিক নিয়মে এক ভদ্রলোক এক ভদ্ররমণীকে বিয়ে করবার জন্যে খেপেছে। দোষে গুণে ছেলেটি চলনসই, মেয়েটির কথা বলা বাহুল্য। এমন অবস্থায় সাধারণ মাসিমার দল স্বভাবের নিয়মেই খুশি হয়ে তখনই ঢেকিতে আনন্দনাড়ু কুটতে শুরু করেন।
‘ভয় নেই বাবা, ঢেকিতে পা পড়েছে। ধরেই নাও লাবণ্যকে তুমি পেয়েইছ। তার পরেও, হাতে পেয়েও যদি তোমার পাবার ইচ্ছে প্রবল থেকেই যায় তবেই বুঝব, লাবণ্যর মতো মেয়েকে বিয়ে করবার তুমি যোগ্য। '
‘আমি যে এ-হেন আধুনিক, আমাকে সুদ্ধ তাক লাগিয়ে দিলেন।'
‘আধুনিকের লক্ষণটা কী দেখলে?'
'দেখছি, বিংশ শতাব্দীর মাসিমারা বিয়ে দিতেও ভয় পান।'
‘তার কারণ, আগেকার শতাব্দীর মাসিমারা যাদের বিয়ে দিতেন তারা ছিল খেলার পুতুল। এখন যারা বিয়ের উমেদার, মাসিমাদের খেলার শখ মেটাবার দিকে তাদের মন নেই।'
'ভয় নেই আপনার। পেয়ে পাওয়া ফুরোয় না, বরং চাওয়া বেড়েই ওঠে, লাবণ্যকে বিয়ে করে এই তত্ত্ব প্রমাণ করবে বলেই অমিত রায় মর্তে অবতীর্ণ। নইলে, আমার মোটর গাড়িটা অচেতন পদার্থ হয়েও অস্থানে অসময়ে এমন অদ্ভুত অঘটন ঘটিয়ে বসবে কেন?'
‘বাবা, বিবাহযোগ্য বয়সের সুর এখনো তোমার কথাবার্তায় লাগছে না, শেষে সমস্তটা বাল্যবিবাহ হয়ে না দাঁড়ায়।'
‘মাসিমা, আমার মনের স্বকীয় একটা স্পেসিফিক গ্র্যাভিটি আছে, তারই গুণে আমার হৃদয়ের ভারী কথাগুলোও মুখে খুব হাল্কা হয়ে ভেসে ওঠে, তাই বলে তার ওজন কমে না।'
যোগমায়া গেলেন ভোজের ব্যবস্থা করতে। অমিত এ ঘরে ও ঘরে ঘুরে বেড়ালে, দর্শনীয় কাউকে দেখতে পেলে না। দেখা হল যতিশংকরের সঙ্গে। মনে পড়ল, আজ তাকে ‘অ্যাণ্টনি ক্লিয়োপ্যাট্রা’ পড়াবার কথা। অমিতর মুখের ভাব দেখেই যতি বুঝেছিল, জীবের প্রতি দয়া করেই আজ তার ছুটি নেওয়া আশু কর্তব্য। সে বললে, “অমিতদা, কিছু যদি মনে না কর আজ আমি ছুটি চাই, আপনার শিলঙে বেড়াতে যাব।'
অমিত পুলকিত হয়ে বললে, ‘পড়ার সময় যারা ছুটি নিতে জানে না তারা পড়ে, পড়া হজম করে না। তুমি ছুটি চাইলে আমি কিছু মনে করব এমন অসম্ভব ভয় করছ কেন?'
‘কাল রবিবার ছুটি তো আছেই, পাছে তুমি তাই ভাব।'
‘ইস্কুল-মাস্টারি বুদ্ধি আমার নয় ভাই, বরাদ্দ ছুটিকে ছুটি বলিই নে। যে ছুটি নিয়মিত, তাকে ভোগ করা আর বাঁধা পশুকে শিকার করা একই কথা। ওতে ছুটির রস ফিকে হয়ে যায়। হঠাৎ যে উৎসাহে অমিতকুমার ছুটিতত্ত্ব-ব্যাখ্যায় মেতে উঠল তার মূল কারণটা অনুমান করে যতির খুব মজা লাগল। সে বললে, 'কয়দিন থেকে ছুটিতত্ত্ব সম্বন্ধে তোমার মাথায় নতুন নতুন ভাব উঠছে। সেদিনও আমাকে উপদেশ দিয়েছিলে। এমন আর কিছুদিন চললেই ছুটি নিতে আমার হাত পেকে যাবে।
‘সেদিন কী উপদেশ দিয়েছিলুম?'
‘বলেছিলে, অকর্ত্যবুদ্ধি মানুষের একটা মহদ্গুণ, তার ডাক পড়লেই একটুও বিলম্ব করা উচিত হয় না। বলেই বই বন্ধ করে তখনই বাইরে দিলে ছুট। বাইরে হয়তো একটা অকর্তব্যের কোথাও আবির্ভাব হয়েছিল, লক্ষ্য করি নি।'
যতির বয়স বিশের কোঠায়। অমিতর মনে যে চাঞ্চল্য উঠেছে ওর নিজের মনেও তার আন্দোলনটা এসে লাগছে। ও লাবণ্যকে এতদিন শিক্ষকজাতীয় বলেই ঠাউরেছিল, আজ অমিতর অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝতে পেরেছে, সে নারীজাতীয়।
অমিত হেসে বললে, 'কাজ উপস্থিত হলেই প্রস্তুত হওয়া চাই, এই উপদেশের বাজার-দর বেশি, আকবরি মোহরের মতো; কিন্তু ওর উল্টো পিঠে খোদাই থাকা উচিত— অকাজ উপস্থিত হলেই সেটাকে বীরের মতো মেনে নেওয়া চাই।'
‘তোমার বীরত্বের পরিচয় আজকাল প্রায়ই পাওয়া যাচ্ছে।'
যতির পিঠ চাপড়িয়ে অমিত বললে, জরুরি কাজটাকে এক কোপে বলি দেবার পবিত্র অষ্টমী তিথি তোমার জীবনপঞ্জিকায় একদিন যখন আসবে দেবীপূজায় বিলম্ব কোরো না ভাই— তার পরে বিজয়াদশমী আসতে দেরি হয় না।'
যতি গেল চলে, অকর্ত্যব্যবুদ্ধিও সজাগ, যাকে আশ্রয় করে অকাজ দেখা দেয় তারও দেখা নেই। অমিত ঘর ছেড়ে গেল বাইরে।
ফুলে আচ্ছন্ন গোলাপের লতা; এক ধারে সূর্যমুখীর ভিড়, আর-এক ধারে চৌকো কাঠের টবে চন্দ্রমল্লিকা। ঢালু ঘাসের খেতের উত্তর-প্রান্তে এক মস্ত য়ুক্যালিপ্টস্ গাছ। তারই গুঁড়িতে হেলান দিয়ে সামনে পা ছড়িয়ে বসে আছে লাবণ্য। ছাই রঙের আলোয়ান গায়ে, পায়ের উপর পড়েছে সকালবেলাকার রোদ্দুর। কোলে রুমালের উপর কিছু রুটির টুকরো, কিছু ভাঙা আখরোট। আজ সকালটা জীবসেবায় কাটাবে ঠাউরেছিল, তাও গেছে ভুলে। অমিত কাছে এসে দাঁড়াল, লাবণ্য মাথা তুলে তার মুখের দিকে চেয়ে চুপ করে রইল, মৃদু হাসিতে মুখ গেল ছেয়ে। অমিত সামনাসামনি বসে বললে, ‘সুখবর আছে। মাসিমার মত পেয়েছি।'
লাবণ্য তার কোনো উত্তর না করে অদূরে একটা নিষ্ফলা পিচগাছের দিকে একটা ভাঙা আখরোট ফেলে দিলে। দেখতে দেখতে তার গুঁঁড়ি বেয়ে একটা কাঠবিড়ালি নেমে এল। এই জীবটি লাবণ্যর মুষ্টিভিখারি-দলের একজন।
অমিত বললে, 'যদি আপত্তি না কর, তোমার নামটা একটু ছেঁটে দেব!' ‘তা দাও।'
‘তোমাকে ডাকব বন্য বলে।'
'বন্য!'
'না না, এ নামটাতে হয়তো বা তোমার বদনাম হল। এরকম নাম আমাকেই সাজে। তোমাকে ডাকব— বন্যা। কী বল?'
'তাই ডেকো, কিন্তু তোমার মাসিমার কাছে নয়।'
‘কিছুতেই নয়। এসব নাম বীজমন্ত্রের মতো, কারো কাছে ফাঁস করতে নেই। এ রইল আমার মুখে আর তোমার কানে!'
‘আচ্ছা বেশ।'
‘আমারও ওই-রকমের একটা বেসরকারি নাম চাই তো। ভাবছি, ব্রহ্মপুত্র কেমন হয়! বন্যা হঠাৎ এল তারই কূল ভাসিয়ে দিয়ে।'
‘নামটা সর্বদা ডাকবার পক্ষে ওজনে ভারী।
‘ঠিক বলেছ। কুলি ডাকতে হবে ডাকবার জন্যে। তুমিই তা হলে নামটা দাও। সেটা হবে তোমারই সৃষ্টি।'
'আচ্ছা, আমি দেব তোমার নাম ছেঁটে। তোমাকে বলব— মিতা।'
‘চমৎকার। পদাবলীতে ওরই একটি দোসর আছে— বঁধু। বন্যা, মনে ভাবছি, ওই নামে নাহয় আমাকে সবার সামনেই ডাকলে, তাতে দোষ কী?'
'ভয় হয়, এক কানের ধন পাঁচ কানে পাছে সস্তা হয়ে যায়।' ‘সে কথা মিছে নয়। দুইয়ের কানে যেটা এক, পাঁচের কানে সেটা ভগ্নাংশ। বন্যা!'
'কী মিতা?'
‘তোমার নামে যদি কবিতা লিখি তো কোন্ মিলটা লাগাব জান?— অনন্যা।'
'তাতে কী বোঝাবে?'
‘বোঝাবে তুমি যা তুমি তাই, তুমি আর-কিছুই নও।'
'সেটা বিশেষ আশ্চর্যের কথা নয়।'
'বল কী, খুবই আশ্চর্যের কথা। দৈবাৎ এক-একজন মানুষকে দেখতে পাওয়া যায় যাকে দেখেই চমকে বলে উঠি, এ মানুষটি একেবারে নিজের মতো; পাঁচজনের মতো নয়। সেই কথাটি আমি কবিতায় বলব—
হে মোর বন্যা, তুমি অনন্যা,
আপন স্বরূপে আপনি ধন্যা।'
‘তুমি কবিতা লিখবে নাকি?'
‘নিশ্চয়ই লিখব। কার সাধ্য রোধে তার গতি?'
‘এমন মরিয়া হয়ে উঠলে কেন?'
‘কারণ বলি। কাল রাত্তির আড়াইটা পর্যন্ত, ঘুম না হলে যেমন এপাশ ওপাশ করতে হয় তেমনি করেই কেবলই অক্সফোর্ড বুক অফ ভর্সেস-এর এ-পাত ও-পাত উল্টেছি। ভালোবাসার কবিতা খুঁজেই পেলুম না, আগে সেগুলো পায়ে পায়ে ঠেকত। স্পষ্টই বুঝতে পারছি, আমি লিখব বলেই সমস্ত পৃথিবী আজ অপেক্ষা করে আছে।' এই বলেই লাবণ্যর বাঁ হাত নিজের দুই হাতের মধ্যে চেপে ধরে বললে, ‘হাত জোড়া পড়ল, কলম ধরব কী দিয়ে? সব চেয়ে ভালো মিল হাতে হাতে মিল। এই-যে তোমার আঙুলগুলি আমার আঙুলে আঙুলে কথা কইছে, কোনো কবিই এমন সহজ করে কিছু লিখতে পারলে না।'
‘কিছুই তোমার সহজে পছন্দ হয় না, সেইজন্যে তোমাকে এত ভয় করি মিতা।'
‘কিন্তু আমার কথাটা বুঝে দেখো। রামচন্দ্র সীতার সত্য যাচাই করতে চেয়েছিলেন বাইরের আগুনে, তাতেই সীতাকে হারালেন। কবিতার সত্য যাচাই হয় অগ্নিপরীক্ষায়, সে আগুন অন্তরের। যার মনে নেই সেই আগুন সে যাচাই করবে কী দিয়ে? তাকে পাঁচজনের মুখের কথা মেনে নিতে হয়, অনেক সময়েই সেটা দুর্মুখের কথা। আমার মনে আজ আগুন জ্বলেছে, সেই আগুনের ভিতর দিয়ে আমার পুরোনো সব পড়া আবার পড়ে নিচ্ছি; কত অল্পই টিকল। সব হু হু শব্দে ছাই হয়ে যাচ্ছে। কবিদের হট্টগোলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আজ আমাকে বলতে হয়, তোমরা অত চেঁচিয়ে কথা কোয়ো না, ঠিক কথাটি আস্তে বলো—For God's sake hold your tongue
and let me love.'
অনেকক্ষণ দুজনে চুপ করে বসে রইল। তার পরে এক সময়ে লাবণ্যর হাতখানি তুলে ধরে অমিত নিজের মুখের উপর বুলিয়ে নিলে। বললে, 'ভেবে দেখো বন্যা, আজ এই সকালে ঠিক এই মুহূর্তে সমস্ত পৃথিবীতে কত অসংখ্য লোকই চাচ্ছে, আর কত অল্প লোকই পেলে। আমি সেই অতি অল্প লোকের মধ্যে একজন। সমস্ত পৃথিবীতে একমাত্র তুমিই সেই সৌভাগ্যবান লোককে দেখতে পেলে শিলঙ পাহাড়ের কোণে এই য়ুক্যালিপ্টস্ গাছের তলায়। পৃথিবীতে পরমাশ্চর্য ব্যাপারগুলিই পরম নম্র, চোখে পড়তে চায় না। অথচ তোমাদের ওই তারিণী তলাপাত্র কলকাতার গোলদিঘি থেকে আরম্ভ করে নোয়াখালি চাটগাঁ পর্যন্ত চীৎকার-শব্দে শূন্যের দিকে ঘুষি উচিয়ে বাঁকা পলিটিক্সের ফাঁকা আওয়াজ ছড়িয়ে এল, সেই দুর্দান্ত বাজে খবরটা বাংলাদেশের সর্বপ্রধান খবর হয়ে উঠল। কে জানে হয়তো এইটেই ভালো।'
'কোন্টা ভালো?'
‘ভালো এই যে, সংসারের আসল জিনিসগুলো হাটেবাটেই চলাফেরা করে বেড়ায়, অথচ বাজে লোকের চোখের ঠোকর খেয়ে খেয়ে মরে না। তার গভীর জানাজানি বিশ্বজগতের অন্তরের নাড়ীতে নাড়ীতে— আচ্ছা বন্যা, আমি তো বকেই চলেছি, তুমি চুপ করে বসে কী ভাবছ বলো তো?'
লাবণ্য চোখ নিচু করে বসে রইল, জবাব করলে না।
অমিত বললে, 'তোমার এই চুপ করে থাকা যেন মাইনে দিয়ে আমার সব কথাকে বরখাস্ত করে দেওয়ার মতো।'
'লাবণ্য চোখ নিচু করেই বললে, 'তোমার কথা শুনে আমার ভয় হয় মিতা।'
‘ভয় কিসের!' ‘তুমি আমার কাছে কী যে চাও, আর আমি তোমাকে কতটুকুই বা দিতে পারি, ভেবে পাই নে।'
‘কিছু না ভেবেই তুমি দিতে পার, এইটেতেই তো তোমার দানের দাম।'
‘তুমি যখন বললে কর্তামা সম্মতি দিয়েছেন, আমার মনটা কেমন করে উঠল। মনে হল, এইবার আমার ধরা পড়বার দিন আসছে।'
‘ধরাই তো পড়তে হবে।'
‘মিতা, তোমার রুচি, তোমার বুদ্ধি আমার অনেক উপরে। তোমার সঙ্গে একত্রে পথ চলতে গিয়ে একদিন তোমার থেকে বহু দূরে পিছিয়ে পড়ব, তখন আর তুমি আমাকে ফিরে ডাকবে না। সেদিন আমি তোমাকে একটুও দোষ দেব না— না না, কিছু বোলো না, আমার কথাটা আগে শোনো। মিনতি করে বলছি, আমাকে বিয়ে করতে চেয়ো না। বিয়ে করে তখন গ্রন্থি খুলতে গেলে তাতে আরো জট পড়ে যাবে। তোমার কাছ থেকে আমি যা পেয়েছি সে আমার পক্ষে যথেষ্ট, জীবনের শেষ পর্যন্ত চলবে। তুমি কিন্তু নিজেকে ভুলিয়ো না।'
'বন্যা, তুমি আজকের দিনের ঔদার্যের মধ্যে কালকের দিনের কার্পণ্যের আশঙ্কা কেন তুলছ?'
‘মিতা, তুমিই আমাকে সত্য বলবার জোর দিয়েছ। আজ তোমাকে যা বলছি তুমি নিজেও তা ভিতরে ভিতরে জান। মানতে চাও না, পাছে যে রস এখন ভোগ করছ তাতে একটুও খটকা বাধে। তুমি তো সংসার ফাঁদবার মানুষ নও, তুমি রুচির তৃষ্ণা মেটাবার জন্যে ফের; সাহিত্যে সাহিত্যে তাই তোমার বিহার, আমার কাছেও সেইজন্যেই তুমি এসেছ। বলব ঠিক কথাটা? বিয়েটাকে তুমি মনে মনে জান, যাকে তুমি সর্বদাই। বল ভাল্গার। ওটা বড়ো রেস্পেক্টেবল্; ওটা শাস্ত্রের দোহাই-পাড়া সেই-সব বিষয়ী লোকের পোষা জিনিস যারা সম্পত্তির সঙ্গে সহধর্মিণীকে মিলিয়ে নিয়ে খুব মোটা তাকিয়া ঠেসান দিয়ে বসে।'
‘বন্যা, তুমি আশ্চর্য নরম সুরে আশ্চর্য কঠিন কথা বলতে পার।'
‘মিতা, ভালোবাসার জোরে চিরদিন যেন কঠিন থাকতেই পারি, তোমাকে ভোলাতে গিয়ে একটুও ফাঁকি যেন না দিই। তুমি যা আছ ঠিক তাই থাকো, তোমার রুচিতে আমাকে যতটুকু ভালো লাগে ততটুকুই লাগুক, কিন্তু একটুও তুমি দায়িত্ব নিয়ো না— তাতেই আমি খুশি থাকব।'
‘বন্যা, এবার তবে আমার কথাটা বলতে দাও। কী আশ্চর্য করেই তুমি আমার চরিত্রের ব্যাখ্যা করেছ। তা নিয়ে কথাকাটাকাটি করব না। কিন্তু একটা জায়গায় তোমার ভুল আছে। মানুষের চরিত্র জিনিসটাও চলে। ঘর-পোষা অবস্থায় তার একরকম শিকলি-বাঁধা স্থাবর পরিচয়। তার পরে একদিন ভাগ্যের হঠাৎ এক ঘায়ে তার শিকলি কাটে, সে ছুট দেয় অরণ্যে, তখন তার আর-এক মূর্তি।'
‘আজ তুমি তার কোনটা?'
'যেটা আমার বরাবরের সঙ্গে মেলে না সেইটে। এর আগে অনেক মেয়ের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল, সমাজের কাটা খাল বেয়ে বাঁধা ঘাটে, রুচির ঢাকা-লণ্ঠন জ্বালিয়ে। তাতে দেখাশোনা হয়, চেনাশোনা হয় না। তুমি নিজেই বলো বন্যা, তোমার সঙ্গেও কি আমার সেই আলাপ?'
লাবণ্য চুপ করে রইল।
অমিত বললে, 'বাইরে বাইরে দুই নক্ষত্র পরস্পরকে সেলাম করতে করতে প্রদক্ষিণ করে চলে, কায়দাটা বেশ শোভন, নিরাপদ— সেটাতে যেন তাদের রুচির টান, মর্মের মিল নয়। হঠাৎ যদি মরণের ধাক্কা লাগে, নিকে-যায় দুই তারার লণ্ঠন, দোঁহে এক হয়ে ওঠবার আগুন ওঠে জ্বলে। সে আগুন জ্বলেছে, অমিত রায় বদলে গেল। মানুষের ইতিহাসটাই এইরকম। তাকে দেখে মনে হয় ধারাবাহিক, কিন্তু আসলে সে আকস্মিকের মালা গাঁথা। সৃষ্টির গতি চলে সেই আকস্মিকের ধাক্কায় ধাক্কায় দমকে দমকে; যুগের পর যুগ এগিয়ে যায় ঝাঁপতালের লয়ে। তুমি আমার তাল বদলিয়ে দিয়েছ বন্যা। সেই তালেই তো তোমার সুরে আমার সুরে গাঁথা পড়ল।'
লাবণ্যর চোখের পাতা ভিজে এল। তবু এ কথা মনে না করে থাকতে পারলে না যে, ‘অমিতর মনের গড়নটা সাহিত্যিক, প্রত্যেক অভিজ্ঞতায় ওর মুখে কথার উচ্ছ্বাস তোলে। সেইটে ওর জীবনের ফসল, তাতেই ও পায় আনন্দ। আমাকে ওর প্রয়োজন সেইজন্যেই। যে-সব কথা ওর মনে বরফ হয়ে জমে আছে, ও নিজে যার ভার বোধ করে কিন্তু আওয়াজ পায় না, আমার উত্তাপ লাগিয়ে তাকে গলিয়ে ঝরিয়ে দিতে হবে।' দুজনে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থেকে লাবণ্য হঠাৎ এক সময়ে প্রশ্ন করলে, ‘আচ্ছা মিতা, তুমি কি মনে কর না যেদিন তাজমহল তৈরি শেষ হল সেদিন মমতাজের মৃত্যুর জন্যে শাজাহান খুশি হয়েছিলেন? তাঁর স্বপ্নকে অমর করবার জন্যে এই মৃত্যুর দরকার ছিল। এই মৃত্যুই মমতাজের সব চেয়ে বড়ো প্রেমের দান। তাজমহলে শাজাহানের শোক প্রকাশ পায় নি, তাঁর আনন্দ রূপ ধরেছে।'
অমিত বললে, 'তোমার কথায় তুমি ক্ষণে ক্ষণে আমাকে চমক লাগিয়ে দিচ্ছ। তুমি নিশ্চয়ই কবি।'
‘আমি চাই নে কবি হতে।'
‘কেন চাও না?
‘জীবনের উত্তাপে কেবল কথার প্রদীপ জ্বালাতে আমার মন যায় না। জগতে যারা উৎসবসভা সাজাবার হুকুম পেয়েছে কথা তাদের পক্ষেই ভালো। আমার জীবনের তাপ জীবনের কাজের জন্যেই।'
‘বন্যা, তুমি কথাকে অস্বীকার করছ? জান না, তোমার কথা আমাকে কেমন করে জাগিয়ে দেয়। তুমি কী করে জানবে তুমি কী বল, আর সে বলার কী অর্থ! আবার দেখছি নিবারণ চক্রবর্তীকে ডাকতে হল। ওর নাম শুনে শুনে তুমি বিরক্ত হয়ে গেছ। কিন্তু কী করব বলো, ওই লোকটা আমার মনের কথার ভাণ্ডারী। নিবারণ এখনো নিজের কাছে নিজে পুরোনো হয়ে যায় নি— ও প্রত্যেক বারেই যে কবিতা লেখে সে ওর প্রথম কবিতা। সেদিন ওর খাতা ঘাঁঁটতে ঘাঁটতে অল্পদিন আগেকার একটা লেখা পাওয়া গেল। ঝর্নার উপরে কবিতা— কী করে খবর পেয়েছে, শিলঙ পাহাড়ে এসে আমার ঝর্না আমি খুঁজে পেয়েছি। ও লিখেছে—
- ঝর্না, তোমার স্ফটিক জলের
- স্বচ্ছ ধারা,
- তাহারি মাঝারে দেখে আপনারে
- সূর্য তারা।
আমি নিজে যদি লিখতুম, এর চেয়ে স্পষ্টতর করে তোমার বর্ণনা করতে পারতুম না। তোমার মনের মধ্যে এমন একটি স্বচ্ছতা আছে যে, আকাশের সমস্ত আলো সহজেই প্রতিবিম্বিত হয়। তোমার সব-কিছুর মধ্যে ছড়িয়ে-পড়া সেই আলো আমি দেখতে পাই। তোমার মুখে, তোমার হাসিতে, তোমার কথায়, তোমার স্থির হয়ে বসে থাকায়, তোমার রাস্তা দিয়ে চলায়।
- আজি মাঝে মাঝে আমার ছায়ারে
- দুলায়ে খেলায়ো তারি এক ধারে,
- সে ছায়ারি সাথে হাসিয়া মিলায়ো
- কলধ্বনি—
- দিয়ে তারে বাণী যে বাণী তোমার
- চিরন্তনী।
তুমি ঝর্না, জীবনস্রোতে তুমি যে কেবল চলছ তা নয়, তোমার চলার সঙ্গে সঙ্গেই তোমার বলা। সংসারের যে-সব কঠিন অচল পাথরগুলোর উপর দিয়ে চল তারাও তোমার সংঘাতে সুরে বেজে ওঠে।
আমার ছায়াতে তোমার হাসিতে
মিলিত ছবি,
তাই নিয়ে আজি পরানে আমার
মেতেছে কবি।
পদে পদে তব আলোর ঝলকে
ভাষা আনে প্রাণে পলকে পলকে,
মোর বাণীরূপ দেখিলাম আজি,
নির্ঝরিণী—
তোমার প্রবাহে মনেরে জাগায়,
নিজেরে চিনি।’
লাবণ্য একটু ম্লান হাসি হেসে বললে, ‘যতই আমার আলো থাক্ আর ধ্বনি থাক্, তোমার ছায়া তবু ছায়াই, সে ছায়াকে আমি ধরে রাখতে পারব না।’
অমিত বললে, ‘কিন্তু একদিন হয়তো দেখবে, আর-কিছু যদি না থাকে আমার বাণীরূপ রয়েছে।’
লাবণ্য হেসে বললে, ‘কোথায়? নিবারণ চক্রবর্তীর খাতায়?’
‘আশ্চর্য কিছুই নেই। আমার মনের নীচের স্তরে যে ধারা বয় নিবারণের ফোয়ারায় কেমন করে সেটা বেরিয়ে আসে।’
‘তা হলে কোনো একদিন হয়তো কেবল নিবারণ চক্রবর্তীর ফোয়ারার মধ্যেই তোমার মনটিকে পাব, আর কোথাও নয়।’
এমন সময় বাসা থেকে লোক এল ডাকতে— খাবার তৈরি।
অমিত চলতে চলতে ভাবতে লাগল যে, ‘লাবণ্য বুদ্ধির আলোতে সমস্তই স্পষ্ট করে জানতে চায়। মানুষ স্বভাবত যেখানে আপনাকে ভোলাতে ইচ্ছা করে ও সেখানেও নিজেকে ভোলাতে পারে না। লাবণ্য যে কথাটা বললে সেটার তো প্রতিবাদ করতে পারছি নে। অন্তরাত্মার গভীর উপলব্ধি বাইরে প্রকাশ করতেই হয়, কেউ-বা করে জীবনে, কেউবা করে রচনায়— জীবনকে ছুঁতে ছুঁতে অথচ তার থেকে সরতে সরতে, নদী যেমন কেবলই তীর থেকে সরতে সরতে চলে তেমনি। আমি কি কেবলই রচনার স্রোত নিয়েই জীবন থেকে সরে সরে যাব! এইখানেই কি মেয়ে-পুরুষের ভেদ? পুরুষ তার সমস্ত শক্তিকে সার্থক করে সৃষ্টি করতে, সেই সৃষ্টি আপনাকে এগিয়ে দেবার জন্যেই আপনাকে পদে পদে ভোলে। মেয়ে তার সমস্ত শক্তিকে খাটায় রক্ষা করতে, পুরোনোকে রক্ষা করবার জন্যেই নতুন সৃষ্টিকে সে বাধা দেয়। রক্ষার প্রতি সৃষ্টি নিষ্ঠুর, সৃষ্টির প্রতি রক্ষা বিঘ্ন। এমন কেন হল? এক জায়গায় এরা পরস্পরকে আঘাত করবেই। যেখানে খুব করে মিল সেইখানেই মস্ত বিরুদ্ধতা। তাই ভাবছি, আমাদের সকলের চেয়ে বড়ো যে পাওনা সে মিলন নয়, সে মুক্তি।'
এ কথাটা ভাবতে অমিতকে পীড়া দিলে, কিন্তু ওর মন এটাকে অস্বীকার করতে পারলে না।