পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৯৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বউ-ঠাকুরানীর হাট \ტ\ტ6? এমন সময় একদিন প্ৰাতঃকালে রামমোহন আসিয়া “মা গো জয় হােক” বলিয়া প্ৰণাম করিল, বিভা এমনই চমকিয়া উঠিল যেন তাহার মাথায় একটা সুখের বীজ ভাঙিয়া পড়িল । তাহার চােখ দিয়া জল বাহির হইল। সে সচকিত হইয়া কহিল, “মোহন, তুই এলি !” “ই মা, দেখিলাম মা আমাদের ভুলিয়া গেছেন, তাহাকে একবার স্মরণ করাইয়া আসি ।” উঠিল না, অথচ শুনিবার জন্য প্ৰাণটা আকুল হইয়া রহিল। রামমোহন বিভার মুখের দিকে চাহিয়া কহিল, “কেন মা, তোমার মুখখানি অমন মলিন কেন ? তোমার চােখে কালি পড়িয়াছে। মুখে হাসি নাই। চুল রুক্ষ । এসো মা, আমাদের ঘরে এসো। এখানে বুঝি তোমাকে যত্ন করিবার কেহ নাই ।” বিভা স্নান হাসি হাসিল, কিছু কহিল না । হাসিতে হাসিতে হাসি আর রহিল না। দুই চক্ষু দিয়া জল পড়িতে লাগিল— শীর্ণ বিবৰ্ণ দুটি কপোল প্লাবিত করিয়া জল পড়িতে লাগিল, অশ্রু আর থামে না । বহুদিন অনাদরের পর একটু আদর পাইলে যে অভিমান উথলিয়া উঠে, বিভা সেই অতিকোমল মৃদু অনন্তপ্রীতিপূর্ণ অভিমানে কঁদিয়া ফেলিল । মনে মনে কহিল, ‘এতদিন পরে কি আমাকে মনে পডিল ?” রামমোহন আর থাকিতে পারিল না, তাহার চোখে জল আসিল, কহিল, “এ কী অলক্ষণ ! মা লক্ষ্মী তুমি, হাসিমুখে আমাদের ঘরে এসে । আজ শুভদিনে চোখের জল মোছো ।” মহিষীর মনে মনে ভয় ছিল, পাছে জামাই তার মেয়েকে গ্ৰহণ না করে । রামমোহন বিভাকে লইতে আসিয়াছে শুনিয়া তাহার অত্যন্ত আনন্দ হইল । তিনি রামমোহনকে ডাকাইয়া জামাইবাড়ির কুশল জিজ্ঞাসা করিলেন, বিশেষ যত্নে রামমোহনকে আহার করাইলেন, রামমোহনের গল্প শুনিলেন, আনন্দে দিন কাটিল । কাল যাত্রার দিন ভালো, কাল প্ৰভাতেই বিভাকে পাঠাইবেন স্থির হইল । প্রতাপাদিত এ বিষয়ে আর কিছু আপত্তি করিলেন না । যাত্রার যখন সমস্তই স্থির হইয়া গেছে, তখন বিভা একবার উদয়াদিত্যের কাছে গেল । উদয়াদিত্য একাকী বসিয়া কী একটা ভাবিতেছিলেন । বিভাকে দেখিয়া সহসা ঈষৎ চমকিত হইয়া কহিলেন, “বিভা, তবে তুই চলিলি ! তা ভালোই হইল । তুই সুখে থাকিতে পারিবি । আশীর্বাদ করি লক্ষ্মীস্বরূপ হইয়া স্বামীর ঘর উজ্জ্বল করিয়া থাক ।” বিভা উদয়াদিত্যের পায়ের কাছে পড়িয়া কঁদিতে লাগিল । উদয়াদিত্যের চোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল, বিভার মাথায় হাত দিয়া তিনি কহিলেন, “কোন কঁদিতেছিস ? এখানে তোর কী সুখ ছিল বিভা, চারি দিকে কেবল দুঃখ কষ্ট শোক । এ কারাগার হইতে পালাইলি— তুই বাচিলি ।” বিভা যখন উঠিল, তখন উদয়াদিত্য কহিলেন, “যাইতেছিস ? তবে আয় । স্বামীগহে গিয়া আমাদের একেবারে যেন ভুলিয়া যাস নে। এক-একবার মনে করিস, মাঝে মাঝে যেন সংবাদ পাই ।” বিভা রামমোহনের কাছে গিয়া কহিল, “এখন আমি যাইতে পারিব না ।” রামমোহন বিস্মিত হইয়া কহিল, “সে কী কথা মা !” বিভা কহিল, “না, আমি যাইতে পারিব না । দাদাকে আমি এখন একলা ফেলিয়া যাইতে পারিব না | আমা হইতেই তাহার এত কষ্ট, এত দুঃখ, আর আমি আজ তাহাকে এখানে ফেলিয়া রাখিয়া সুখ ভোগ করিতে যাইব ? যতদিন তাহার মনে তিলমাত্ৰ কষ্ট থাকিবে ততদিন আমিও তাহার সঙ্গে সঙ্গে । থাকিব । এখানে আমার মতো তাহাকে কে যত্ন করিবে ?” বলিয়া বিভা কঁদিয়া চলিয়া গেল । অন্তঃপুরে একটা গোলযোগ বাধিয়া উঠিল। মহিষী আসিয়া বিভাকে তিরস্কার করিতে লাগিলেন, তাহাকে অনেক ভয় দেখাইলেন, অনেক পরামর্শ দিলেন । বিভা কেবল কহিল, “না মা, আমি পারিব না ।” মহিষী রোষে বিরক্তিতে কঁাদিয়া কহিলেন, “এমন মেয়েও তো কোথাও দেখি নাই।” তিনি