পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৩৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

WS NR রবীন্দ্র রচনাবলী অনুশাসন। কোন নদীতে স্নান করলে পূণ্য, কোন খাদ্য আহার করলে পাপ, কোন দিকে মাথা রেখে শুতে হবে, কোন মন্ত্র কিরকম নিয়মে কোন তিথিতে কোন দণ্ডে উচ্চারণ করা আবশ্যক, এই সমস্তই তখন ধর্মানুষ্ঠান । এমনি করে দৃষ্টি স্বাণ স্পর্শদি-দ্বারা, মনের দ্বারা, কল্পনার দ্বারা, ভয়ের দ্বারা, ভক্তির দ্বারা বাহিরকে নানারকম করে নেড়েচড়ে তাকে নানারকমে আঘাত করে এবং তার দ্বারা আঘাত খেয়ে আমরা বাহিরের পরিচয়ের সীমায় এসে ঠেকি । তখন বাহিরকেই আর পূর্বের মতো একমাত্র বলে মনে হয় না । তখন তাকেই আমাদের একমাত্র গতি, একমাত্র আশ্রয়, একমাত্র সম্পদ বলে আর জানি নে । সে আমাদের সম্পূর্ণ আশাকে জাগিয়ে তুলে একদিন আমাদের সমস্ত মনকে টেনে নিয়েছিল বলেই, যখন আমরা তার সীমা দেখতে পেলুম তখন তার উপরে আমাদের একান্ত অশ্রদ্ধা জন্মল। তখন প্রকৃতিকে মায়াবিনী বলে গাল দিতে লাগলুম, সংসারকে একেবারে সর্বতোভাবে অস্বীকার করবার জন্যে মনে বিদ্রোহ জন্মাল। তখন বলতে লাগলুম— যার মধ্যে কেবলই আধিব্যাধি মৃত্যু, কেবলই ঘানির বলদের চলার মতো অনন্ত প্ৰদক্ষিণ, তাকে আমরা সত্য বলে, তারই কাছে আমরা সমস্ত আত্মসমৰ্পণ করেছিলুম- আমাদের এই মুঢ়তাকে ধিক । তখন বাহিরকে নিঃশেষে নিরস্ত করে দিয়ে আমরা অন্তরেই বাসা বঁধবার চেষ্টা করলুম। যে-বাহিরকে একদিন রাজা বলে মেনেছিলুম, তাকে কঠোর যুদ্ধে পরাস্ত করে দিয়ে ভিতরকেই জয়ী বলে প্রচার করলুম ! যে-প্রবৃত্তিগুলি এতদিন বাহিরের পেয়াদা হয়ে আমাদের সর্বদাই বাহিরের তাগিদেই ঘুরিয়ে মেরেছিল তাদের জেলে দিয়ে, শূলে চড়িয়ে, ফাঁসি দিয়ে, একেবারে নির্মূল করবার চেষ্টায় প্রবৃত্ত হলুম। যে-সমস্ত কষ্ট ও অভাবের ভয় দেখিয়ে বাহির আমাদের দাসত্বের শৃঙ্খল পরিয়েছিল, সেই সকল কষ্ট ও অভাবকে আমরা একেবারে তুচ্ছ করে দিলুম। রাজসূয় যজ্ঞ করে উত্তরে দক্ষিণে পূর্বে পশ্চিমে বাহিরের সমস্ত দাের্দণ্ডপ্রতাপ রাজাকে হার মানিয়ে জয়পতাকা আমাদের অন্তররাজধানীর উচ্চ প্ৰসাদ চুড়ায় উড়িয়ে দিলুম। বাসনার পয়ে শিকল পরিয়ে দিলুম। সুখ-দুঃখকে কড়া পাহারায় রাখলুম, পূর্বতন রাজত্বকে আগাগোড়া বিপর্যস্ত করে তবে ছাড়লুম। এমনি করে বাহিরের একান্ত প্ৰভূত্বকে খর্ব করে যখন আমাদের অন্তরে প্রতিষ্ঠা লাভ করলুম। তখন অন্তরতম গুহার মধ্যে এ কী দেখি ? এ তো জয়গর্ব নয়। এ তো কেবল আত্মশাসনের অতিবিস্তারিত সুব্যবস্থা নয়। বাহিরের বন্ধনের স্থানে এ তাে কেবল অন্তরের নিয়মবন্ধন নয়। শান্তদান্ত সমাহিত নির্মল চিদাকাশে এমন আনন্দজ্যোতি দেখলুম। যা অন্তর এবং বাহির উভয়কেই উদভাসিত করেছে, অন্তরের নিগুঢ় কেন্দ্র থেকে নিখিল বিশ্বের অভিমুখে যার মঙ্গলরািশ্মরাজি বিছুরিত হচ্ছে। তখন ভিতর বাহিরের সমস্ত দ্বন্দ্ব দূর হয়ে গেল। তখন জয় নয়, তখন আনন্দ ; তখন সংগ্রাম নয়, তখন লীলা ; তখন ভেদ নয়, তখন মিলন ; তখন আমি নয়, তখন সব— তখন বাহিরও নয়, ভিতরও নয়, তখন ব্ৰহ্ম— তছুত্ৰং জ্যোতিষাং জ্যোতিঃ । তখন আত্মা-পরমাত্মার পরম মিলনে বিশ্বজগৎ সম্মিলিত | তখন স্বার্থবিহীন করুণা, ঔদ্ধত্যবিহীন ক্ষমা, অহংকারবিহীন প্ৰেম- তখন জ্ঞানভক্তিকর্মে বিচ্ছেদবিহীন পরিপূর্ণতা। ९० शाम ४७४१