ছবির সহিত পূরোবর্ত্তী বাস্তবের তুলনা করিতেই ব্যস্ত; কিন্তু, হায়: উভয়ের মধ্যে কোথাও বড় একটা সামঞ্জস্য খুঁজিয়া পাইতেছে না। তা নাই-ই হইল, সেজন্য সে দুঃখিত নয়;—প্রত্যক্ষ বর্ত্তমান পাইলে, কে আর অনুমানের সাহায্য-প্রত্যাশী হইতে চাহে? এখানে চারিদিকে সবই কেবল শাদা। কবিগণ কেন শুভ্রতার মধ্যে সততই প্রসন্নতাকে পান, আজ তাহা স্পষ্ট বুঝিতে পারিলাম। আর প্রসন্নতাই যে পবিত্রতার আধার, সে সত্যেও আর সংশয় রহিল ন!— শরীরটাকে টানিয়া উঁচুতে তুলিয়াছি সত্য, কিন্তু হৃদয়কেও কি অনুরূপ উন্নত করিতে পারিয়াছি? সেও কি সত্যই আশেপাশে এমনই শুভ্রতার মধ্য দিয়া চলিয়াছে?—বুঝি বা তাই! নচেৎ সে এত প্রসন্নতা পাইবে কোথায়?
এতক্ষণ সঙ্গীদের সঙ্গে কথাবার্ত্তা চলিতেছিল; এখন কে যেন আসিয়া কণ্ঠরোধ করিয়া দিয়া গেল ভয়ে জিহ্বা একেবারে আড়ষ্ট প্রায়। এ শাসন কেন?—প্রথমে কিছু বুঝিতে পারিলাম না। পরে চাহিয়া দেখি, দীর্ঘ জটাধারী যোগনিষ্ঠ যোগিগণ, নিস্পন্দ নিশ্চলভাবে ধ্যানে নিমগ্ন রহিয়াছেন। এ পুণ্য-স্থানে প্রবেশের পূর্ব্বে সকলেরই বাক্য ও মন সংযত রাখিতে হয় যেন তাহাদের কোন মতে যোগভঙ্গ না হয়। আমাদের প্রতি যে ঐরূপ আদেশ হইয়াছিল কেন, এতক্ষণে তাহা বুঝিলাম। এখন যে চলিয়াছি, সে এক মহান্ সত্তার মধ্য দিয়া,—তাহাতে শৈত্য-বোধ নাই, বা শ্রান্তিক্লান্তিও অনুভূত হয় না। চারিদিকে “আনন্দরূপমমৃতম্”, আর অন্তরে “তত্ত্বমসি” —এই ঋষি বচনের সার্থকতা উপলব্ধি করা—এখন এইমাত্র কার্য্য! অবশেষে, সেই ভুবনমনোমমোহিনী যাদুকরীর দিকে তাকাইয়া, জিজ্ঞাসা করিলাম, “আর কত দূরে নিয়ে যাবে মোরে, হে সুন্দরি!”—কোনই উত্তর পাইলাম না। এবার আরও দুই একখানা কাল’ মেঘ আকাশে দেখা দিল, অমনই ভাস্করও পরম-বন্ধুর মত উহাদের স্কন্ধে ভর দিয়া আসিয়া দাঁড়াইলেন; বুঝিবা কৌতূহলী হইয়া জানিতে আসিয়াছেন যে, সুদূর দেশান্তরে— প্রাচ্যদেশে যাঁহার প্রভূত-প্রতাপে জীবলোক সতত ঘর্মাক্ত-কলেবর হইয়া পড়ে, আজ তাঁহার এ সৌম্যভাব কেমন দেখিতেছি!—থাক্ সে কথা। সূর্য্যদেবের স্বভাব, সকলকে চঞ্চল করিয়া তোলা;—নতুবা তাঁর তৃপ্তি নাই—অথচ সৃষ্টির আরম্ভ হইতে যে নীরব-নিভৃতে, একান্তে যোগসাধনা চলিয়াছে—কা’র সাধ্য আছে যে, সে সাধনায় বিঘ্ন ঘটায়?—তাই, অচল-অটল জানিয়া, অনাদিকাল হইতেই তিনি শৈলশৃঙ্গ ত্যাগ করিতে বাধ্য হইয়াছেন, এবং তৎসংক্রান্ত যাহাকিছু, সকলেই তাঁর বিতৃষ্ণা? তা’ না হইবেই