ধম্মপদ/ধর্ম্মস্থ বর্গ

উইকিসংকলন থেকে

ঊনবিংশ সর্গ—ধর্ম্মস্থবর্গ।

বলক্রমে যদি কেহ কা'রো অর্থ[১] লয়
সেজন ধার্ম্মিক বলি' কথিত না হয়;

অর্থ বা অনর্থ যা’র উভয় সমান
সেজন পণ্ডিতরূপে পান শ্রেষ্ঠস্থান॥১॥
বলের প্রয়োগ কভু না করি যেজন
ন্যায়ধর্ম্ম বলে পরে করেন চালন,
ধর্ম্মেতে রক্ষিত সেই মেধাবী পণ্ডিত
ধর্ম্মস্থ[২] বলিয়া সদা হন সুবিদিত॥২॥
বহুবাক্য বলিলেই পণ্ডিত না হয়;
(অনায়াসে কেহ কভু পাণ্ডিত্য না পায়)—
হিতকারী,দ্বেষহীন,নির্ভীক যে নর
পণ্ডিত বলিয়া খ্যাতি নর-লোকে তা’র॥৩॥
যাবত সংসারে কেহ বহু বাক্য কয়
ততদিন ধর্ম্মরক্ষা তাহার না হয়;

অল্পমাত্র ধর্ম্ম কথা করিয়া শ্রবণ
সই মত কার্য্য যিনি করেন সাধন,
ধর্ম্মের পালক ভবে তিনিই নিশ্চয়
তাহার ধর্ম্মেতে কভু প্রমাদ না হয়॥৪॥
মস্তক পলিত কেশে যা’র সমাবৃত
তিনিই স্থবির[৩] বলি না হন কথিত।
বয়স হ’য়েছে বটে পরিপক্ক তা’র
তাই তিনি “বৃথা বৃদ্ধ” বলিয়া প্রচার॥৫॥২৬০॥
আছে সত্য, দম, ধর্ম্ম, অহিংসা যাহার
নির্ম্মল সে ধীর জন স্থবিরে প্রচার॥৬॥
মাৎসর্য্য শঠতা ঈর্ষা পূর্ণ যেইজন
বাক্যে কিম্বা রূপে সাধু সে নহে কখন॥৭॥
এ সকল সমুচ্ছিন্ন যাহার সমূলে,
নির্দ্দোষ সে মেধাবীকে ‘সাধু’ সবে বলে॥৮॥

মিথ্যাবাদী, ব্রতহীন হয় যেইজন
মস্তক মুণ্ডন করি না হয় শ্রমণ;
লোভ বা কামনা যা’র হয় নাই গত,
কিরূপে শ্রমণবলি’ হ’বে সে কথিত!॥৯॥
ছোট বড় পাপ যত করে যে বর্জ্জন
পাপের শমতা হেতু সে হয় শ্রমণ॥১০॥
পরদ্বারে ভিক্ষা করি ভিক্ষু নাহি হয়
ভক্ষু সে, সমগ্রধর্ম্মে যাহার আশ্রয়॥১১॥
ইহলোকে পুণ্য পাপ করি অতিক্রম
ব্রহ্মচর্য্য ব্রত রত হয় সেইজন,
জ্ঞানের সন্ধানে সদা করি বিচরণ
ভিক্ষু নামে সেইজন সমাখ্যাত হন॥১২॥
অতিমৃুঢ় অবিদ্বান যেইজন হয়
মৌনী হ’লে লোকে তা’রে ‘মুনি’ নাহি কয়।
যে পণ্ডিত তুলাদণ্ড করিয়া ধারণ
পাপ ত্যজি সার যাহা করয়ে গ্রহণ,

বিচার করিয়া কার্য্য সাধন যে করে,
উভয় লোকেতে লোকে মুনি বলে তা'রে॥১৩—১৪॥
জীব হিংসা করি লোকে “আর্য্য” নাহি হয়,
সর্ব্বজীবে অহিংসায় আর্য্য নাম পায়॥১৫॥[৪](২৭০)
সুশীলতা, ব্রতাচার, শাস্ত্র অধ্যয়নে
সমাধির লাভে কিম্বা একাকী শয়নে
পবিত্র নৈষ্ক্রম্য সুখ[৫] না পায় কখন—
আস্বাদ না পায় যা'র মূর্খ কদাচন॥

 যাবৎ দোষের তব ক্ষয় না হইবে
তাবৎ নিশ্চিন্তভাবে কভু না রহিবে॥১৬-১৭॥


    সাম্প্রদায়িক ভাব আসিয়া পড়ে। সম্ভবতঃ সেরূপ সাম্প্রদায়়িকতা তথাগতের উদ্দেশ্য ছিল না। এইজন্য পণ্ডিতপ্রবর মোক্ষমুলর “বাহিরে” শব্দ “বাহ্য অর্থাৎ যাহা আধ্যাত্মিক নহে”―এই অর্থে গ্রহণ করেন। “A Samana is not a Samana by outward acts, but by his heart.” শ্লোকের প্রকৃত অর্থ এইঃ—আকাশে যেমন চলিবার পথ নাই, তেমনি বাহিরের হাব ভাবে শ্রমণত্ব প্রকাশ পায় না।

  1. অর্থ - পদার্থ।
  2. ধর্ম্মস্থ - ধার্ম্মিক। মোক্ষমুলর ও বীল উভয়ই ধর্ম্মস্থ শব্দ “ন্যায়পর” (just) অর্থে বুঝিযাছেন। “Firmly holding by the law.”
  3. বৌদ্ধভিক্ষুর অন্য নাম স্থবির।
  4. এস্থলে ভিক্ষু, মুনি ও আর্য্য প্রভৃতি শব্দের যে সকল অদ্ভুত অর্থ প্রদত্ত হইয়াছে, তাহার সহিত ঐ সকল শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থের বিশেষ কোন সম্বন্ধ নাই। ভিক্ষু শব্দে প্রকৃত পক্ষে যে বৗদ্ধ শ্রমণ গৃহ সংসার ত্যাগ করিয়া সম্পূর্ণরূপে ভিক্ষার উপরই জীবিকার জন্য নির্ভর করেন, তাহাকেই বুঝায়। জ্ঞানী ব্যক্তিই মুনি; শাক্যমুনি শব্দের মধ্যে মুনি শব্দ এই অর্থেই প্রযুক্ত হইয়াছে। “আর্য্য” শব্দের অর্থ “সন্মানার্হ”; সুতরাং যিনি ধর্ম্ম জীবন গ্রহণ করেন তিনিই আর্য্য। [See “Sacred Books of the East” Vol. X p. 65.]
  5. পরিত্রাণজনিত সুখ।