নব্য জাপান ও রুষ জাপান যুদ্ধের ইতিহাস/জাপানের শিক্ষা-প্রণালী

উইকিসংকলন থেকে

জাপানের শিক্ষা-প্রণালী।

 সুশিক্ষাই সর্ব্ববিধ উন্নতির মূল। কি সাম্রাজ্যের পরিপুষ্টি, কি বাণিজ্যের বিপুলবিস্তার, কি স্বদেশের শ্রীবৃদ্ধিসাধন, কি জ্ঞানের পরিধি প্রসারণ, ইহার কোন একটিও শিক্ষা নিরপেক্ষ নহে। জাপানবাসীরা গত ত্রিংশতি বৎসর মধ্যে শিক্ষাবিষয়ে যে উন্নতিলাভ করিয়াছে, তাহা পৃথিবীর ইতিহাসে অতি অপূর্ব্ব ও সর্ব্বাপেক্ষা বিস্ময় জনক।

 জাপানের শিক্ষার ইতিহাস ১৮৬৮ খৃঃ হইতে আরম্ভ হইয়াছে। ইহার তিন বৎসর পরে গবর্ণমেণ্টের তত্ত্বাবধানে জাপানে “মম্বাসাে” অর্থাৎ শিক্ষাবিভাগ স্থাপিত হয়। ১৮৭২ খৃঃ শিক্ষাসংক্রান্ত কতকগুলি ব্যবস্থা প্রণীত হইয়া শিক্ষাবিভাগে নবযুগের আবির্ভাব হয়।

 এক্ষণে জাপানে চারিশ্রেণীর বিদ্যালয় দৃষ্ট হয়। যথা,— প্রাথমিক বিদ্যালয়, মধ্য-বিদ্যালয়, উচ্চ-বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়।

 প্রাথমিক বিদ্যালয় জাপানের প্রতি “সান” অর্থাৎ পল্লীগ্রামে দৃষ্ট হয়। ইহাতে ষষ্ঠ বৎসর হইতে চতুর্দ্দশ বর্ষীয় বালক বালিকাগণকে জাপানী ভাষায় শিল্প, কৃষি, বাণিজ্য, গণিত ও স্বাস্থ্যরক্ষা বিষয়ক সাধারণ সূত্রগুলি শিক্ষা দেওয়া হয়। পীড়িত ও অতি দরিদ্র ব্যতীত গ্রামের সকল বালক বালিকাই এই বিদ্যালয়ে আসিতে বাধ্য হইয়া থাকে। এই সমস্ত বিদ্যালয়গুলি গবর্ণমেণ্ট ও গ্রামবাসীর অর্থ সাহায্যে রক্ষিত হইয়া থাকে। ১৯০২ খৃঃ এই শ্রেণীর বিদ্যালয়-সংখ্যা ২৮,৩৮১, ছাত্র ও ছাত্রী সংখ্যা ৪৯,৮০,৬০৪ ও শিক্ষক এবং শিক্ষয়ত্রী সংখ্যা ১,০৩৭৮০ জন ছিল।

 জাপানের প্রতি জেলাতেই এক বা ততােধিক মধ্য-বিদ্যালয় অবস্থিত আছে। এই সমস্ত বিদ্যালয়ে চৌদ্দ হইতে অষ্টাদশ বর্ষ বয়স্ক বালক বালিকাদিগকে জাপানী, চীনা ও ইংরাজী ভাষায় সাহিত্য, ইতিহাস, ভূগােল, গণিত, জ্যামিতি, বিজ্ঞান, রসায়ন, জ্যোতিষ প্রভৃতি বিবিধ বিষয় শিক্ষা দেওয়া হয়। যাহাতে ছাত্র ও ছাত্রীগণের ধর্ম্মজ্ঞান, নীতি ও শারীরিক শক্তি সম্যক পরিপুষ্ট হয়, তাহার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখা হয়। ১৯০২ সালে এই শ্রেণীর বিদ্যালয়ের সংখ্যা ২৯২, ছাত্র ও ছাত্রী সংখ্যা ১,০২,৩০৪ এবং শিক্ষক ও শিক্ষায়ত্রী সংখ্যা ৪২৩৩ জন ছিল।

 উচ্চ বিদ্যালয় গুলি রাজধানী ও প্রধান নগরে অবস্থিত। ইহাতে জাপানী, ইংরাজী ও জর্ম্মান ভাষায় গণিত, দর্শন, সাহিত্য, বিজ্ঞান, আইন, চিকিৎসা-শাস্ত্র, কৃষি, বাণিজ্য, ভূতত্ব প্রভৃতি বিবিধ বিষয়ের শিক্ষা দেওয়া হইয়া থাকে। এই বিদ্যালয়ে সপ্তদশ বৎসরের ন্যূন বয়স্ক কোন ছাত্র প্রবিষ্ট হইতে পারে না। ১৯০৩ খৃঃ জাপানের উচ্চ-বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৮টী ও ছাত্র সংখ্যা ৪৬৮১ জন ছিল।

 জাপানে ৭০টী উচ্চ বালিকাবিদ্যালয় ও ৫৪টি নর্ম্মাল বিদ্যালয় আছে। নর্ম্মাল বিদ্যালয়ে ছাত্রগণকে চারি বৎসর ও ছাত্রীগণকে তিন বৎসর অধ্যয়ন করিতে হয়। নর্ম্মাল বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষয়িত্রী প্রস্তুত করিবার জন্য আবার দুইটী উচ্চ নর্ম্মাল বিদ্যালয় আছে। ইহার একটী টোকিয়ে রাজধানীতে ও অন্যটী হিরােসিমা নগরে অবস্থিত। গত পূর্ব্ব বর্ষে ইহার ছাত্র সংখ্যা ৮০৩ জন ও ছাত্রী সংখ্যা ৩৬১ জন ছিল।

 জাপানে দুইটী “দৈগাকু” অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় আছে। ইহার একটী রাজধানীতে ও অন্যটী মিয়াকো নগরে অবস্থিত। উচ্চবিদ্যালয়ের উত্তীর্ণ ছাত্র ভিন্ন কেহই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবিষ্ট হইতে পারে না।

 টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়,এখানে আইন, চিকিৎসা, ইঞ্জিনিয়ারিং সাহিত্য, বিজ্ঞান ও কৃষিবিদ্যা বিষয়ক ৬টী কলেজ আছে। আইন বিভাগের মধ্যে চিকিৎসা সম্বন্ধে একটী নির্দ্দিষ্ট পাঠ্য আছে। ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের মধ্যে গৃহনির্ম্মাণ, রসায়ন, বারুদ, খনি ও ধাতু সম্বন্ধে নয়প্রকার পাঠ্য আছে। সাহিত্য কলেজে দর্শন, জাপানী-সাহিত্য, চীন-সাহিত্য, ইতিহাস ও বিবিধ বৈদেশিক সাহিত্য প্রভৃতি নয়প্রকার পাঠ্য আছে। বিজ্ঞান কলেজে গণিত, জ্যোতিষ, পদার্থবিদ্যা, প্রাণীবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা প্রভৃতি সাতপ্রকার পাঠ্য আছে। কৃষি কলেজে কৃষিবিদ্যা, বনবিদ্যা প্রভৃতি চারি প্রকার পাঠ্য আছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সহিত একটা বৃহৎ পুস্তকাগার ও হাঁসপাতাল আছে। আইন কলেজে কতদিন পাঠ করিতে হইবে তাহার নিশ্চয়তা নাই। অন্যান্য কলেজে তিন বৎসর অধ্যয়ন করিতে হয়। কোন ছাত্রকেই সাত বৎসরের অধিক কাল পড়িতে দেওয়া হয় না।

 টোকিয়ো বিশ্ব-বিদ্যালয়ে বর্ত্তমান বৎসরে আইনবিভাগে ২৫, চিকিৎসাবিভাগে ২৩, ইঞ্জিনিয়ারিংবিভাগে ২৫, সাহিত্যবিভাগে ২০, বিজ্ঞানবিভাগে ২১, ও কৃষিবিভাগে ১৭ জন অধ্যাপক আছেন।

 এই বিশ্ব-বিদ্যালয় হইতে চিকিৎসাশাস্ত্রে উত্তীর্ণ হইলে ইগাকুশী, ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যায় উত্তীর্ণ হইলে কোগাকুশী, সাহিত্যে উত্তীর্ণ হইলে বানগাকুশী, বিজ্ঞানশাস্ত্রে উত্তীর্ণ হইলে রিগাকুশী ও কৃষিবিদ্যায় উত্তীর্ণ হইলে নােগাকুশী উপাধি পাওয়া যায়।

 জাপান গবর্ণমেণ্ট টোকিও বিশ্ব-বিদ্যালয়ের জন্য প্রতিবর্ষে প্রায় ২০ লক্ষ টাকা ব্যয় করিয়া থাকেন।

 এই বিশ্ব-বিদ্যালয়ে ছাত্রসংখ্যা বর্ষে বর্ষে কি পরিমাণে বর্দ্ধিত হইতেছে, তাহা নিম্নলিখিত তালিকা হইতে বুঝিতে পারা যায়।

১৮৯০ ১৮৯৫ ১৯০০ ১৯০৩

আইন ৩০১ ৪৭২ ৮২০ ১২০৮
চিকিৎসা ১৮৮ ১৭৮ ৪০২ ৭১৭
ইঞ্জিনিয়ারিং ১০৬ ২৯৫ ৪০৭ ৯০১
সাহিত্য ৮৮ ২১৯ ৩১২ ৮৩৩
বিজ্ঞান ৭৭ ১০২ ১০৫ ২১৩
কৃষি ৪৮৫ ২৪৯ ২৬২ ৪৯৪
বিবিধ ৪৮ ১০৫ ১৯২ ২৫০

১,২৯৩ ১,৬২০ ২,৫০০ ৪,৬১৬
 কিয়াটো বিশ্ব-বিদ্যালয়ে আইন, চিকিৎসা, বিজ্ঞান এবং ইঞ্জিনিয়ারিং প্রভৃতির চারিটী কলেজ আছে। এখানে কোন ছাত্রকে তিন বৎসরের অধিক কাল এক প্রকার পাঠ্য পাঠ করিতে দেওয়া হয় না। চিকিৎসা কলেজে চারি বৎসর অধ্যয়ন করিতে হয়। অন্যান্য নিয়মাদি টোকিও বিশ্ব-বিদ্যালয়ের অনুরূপ।

 বিশ্ব-বিদ্যালয়ের বাৎসরিক ফিজ ৩৭॥৹ টাকা। ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্রগণকে আরও ১৫৲ টাকা অতিরিক্ত প্রদান করিতে হয়।

 এই দুইটী বিশ্ববিদ্যালয় হইতে গত ২৫ বৎসরে প্রায় ৫০০০ ছাত্র উত্তীর্ণ হইয়াছে।

 টোকিও ও কিয়াটো বিশ্ব-বিদ্যালয় ভিন্ন জাপানে শিল্প, কৃষি ও স্ত্রীশিক্ষাসংক্রান্ত আরও কয়েকটী বিশ্ব-বিদ্যালয় আছে।

 উপরােক্ত বিদ্যালয়সমূহ ভিন্ন জাপানে উচ্চ ও নিম্নশ্রেণীর ১৪৭৪টী বিদ্যালয় বর্ত্তমান আছে। তন্মধ্যে ৪৭টী কৃষি, ২০০টী শিল্প, ৩৬টী বাণিজ্যবিষয়ক বিদ্যালয় উল্লেখ যােগ্য। শিল্প বিদ্যালয়ের মধ্যে টোকিও উচ্চ শিল্প বিদ্যালয়, ওসাকা শিল্প বিদ্যালয় ও কিয়াটো উচ্চ শিল্প বিদ্যালয় সমধিক প্রসিদ্ধ। এই সমস্ত বিদ্যালয়ে রসায়ণ, বৈদ্যুতিক যন্ত্রাদি গঠন, রং করণ, বস্ত্র বয়ন, চীনাবাসন গঠন, মদ্য প্রস্তুত করণ, ধাতুবিদ্যা, মানচিত্র অঙ্কিত করণ, চিত্রবিদ্যা প্রভৃতি বিবিধ বিষয় হাতে কলমে শিক্ষা দেওয়া হয়।

 এক্ষণে জাপানে ১৬টী মূকবধির বিদ্যালয় ও ২৫৪টী কিণ্ডারগার্টেন বিদ্যালয় বিদ্যমান আছে।

 জাপান গবর্ণমেণ্ট ১৮৭০ খৃষ্টাব্দ হইতে শিল্প ও বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য বিদেশে ছাত্র প্রেরণ আরম্ভ করেন। ১৮৭২ অব্দে প্রায় ২৫০ ছাত্র প্রেরিত হইয়াছিল। ১৮৯৫ অব্দে কেবল মাত্র ১১ জন প্রেরিত হয়। পূর্ব্বে জাপানী বিদ্যালয়ের জন্য ইউরােপ ও আমেরিকা হইতে অধ্যাপক আনিতে হইত, এক্ষণে তাহার প্রয়ােজন হয় না।

 সমগ্র জাপান রাজ্যে বর্ত্তমান সময়ে প্রায় ৫৪ লক্ষ ছাত্র বিবিধ বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করিতেছে। এখানে বিদ্যালয় গমনযােগ্য বালক ও যুবকবর্গের মধ্যে শতকরা ৮৫ জন বিদ্যালয়ে গমন করিয়া থাকে। আমেরিকার যুক্তরাজ্য (ইউনাইটেডষ্টেটস্) পৃথিবীর মধ্যে সর্ব্বাপেক্ষা সুসভ্য রাজ্য বলিয়া পরিগণিত। প্রাথমিক শিক্ষা বিষয়ে সেই শক্তিশালী রাজ্যের সহিতও জাপানের তুলনা হয় না। হতভাগ্য ভারতের সহিত আর কি তুলনা করিব?

 জাপানীরা ইংলণ্ডের নিকট হইতে নৌবিদ্যা, ফ্রান্সের নিকটে যুদ্ধবিদ্যা, জার্ম্মানির নিকট হইতে চিকিৎসাশাস্ত্র এবং আমেরিকার নিকট হইতে শিক্ষাপ্রণালী গ্রহণ করিয়া সকলগুলিই স্বদেশের উপযোগী করিয়া লইয়াছে। কোন বিষয়েই আমাদের ন্যায় অবিকল অনুকরণ করে নাই।

 জাপান সম্রাট বলিয়াছিলেন,—“It is designed, henceforth, education shall be so diffused that there may not be a village with an ignorant family, nor a family with an ignorant member.” সম্রাটের এই উক্তি সার্থক হইয়াছে।