পাখীর কথা/প্রথম ভাগ/পাখীর খাঁচা

উইকিসংকলন থেকে

পাখীর খাঁচা

 বিহঙ্গতত্ত্ববিদ্ পাশ্চাত্য পণ্ডিতগণ পাখীদিগকে পিঞ্জরে রাখিয়া যে ভাবে ও যে উদ্দেশ্যে পালন করেন তাহা একেবারে নূতন। স্বাধীন অবস্থায় পাখীরা যে ভাবে থাকে—উহাদের উপযোগী খাদ্যাদি, রৌদ্রের উত্তাপ, বিশুদ্ধ বায়ু,Aviculture কাহাকে বলে পানীয় জল, অতিরিক্ত তাপ এবং ঝড়বৃষ্টি হইতে রক্ষা করিবার জন্য আচ্ছাদিত স্থান প্রভৃতি প্রাণধারণের অত্যাবশ্যক সামগ্রীগুলি উহাদিগকে সুপ্রণালীতে উপভোগ করিতে দিয়া যাহাতে পাখীগুলি আপনাদিগের আবদ্ধ জীবনের ক্লেশ অণুমাত্র অনুভব করিতে না পারে, তাহাই পণ্ডিতগণ প্রথমে বিশেষভাবে করিয়া থাকেন। পাখীগুলিও এই প্রকারে পালকদিগের যত্নে রক্ষিত হইয়া, মনের আনন্দে গান গাহিয়া পুচ্ছ দোলাইয়া পিঞ্জরের মধ্যে উড়িয়া বেড়ায়; পরে যথাসময়ে মনোমত পত্নী-সহযোগে শাবকোৎপাদন করিয়া আপনাদের জীবন সুখময় করিয়া তোলে। এই প্রণালীতে পক্ষিপালনই য়ুরোপে Aviculture নামে অভিহিত হয়। এই Aviculture বা পক্ষিপালনপ্রণালী কিরূপে মানবের বৈজ্ঞানিক চেষ্টাকে সফলতাভিমুখে লইয়া গিয়াছে, কেমন করিয়া প্রকৃতির নানা গোপন জীবরহস্যের প্রতি নূতন আলোকরশ্মি নিক্ষেপ করিতেছে, তাহার কিঞ্চিৎ আভাস আমরা ক্রমশঃ দিতে চেষ্টা করিব।

 পালন-ব্যাপারে সার্থকতা লাভ করিতে হইলে, কতকগুলি উপকরণের একান্ত প্রয়োজন। এই উপকরণগুলি সংগ্রহ করা পালকের পক্ষে যেরূপ বাঞ্ছনীয়, বিহঙ্গগুলির স্বাভাবিক অবস্থাউপকরণ-সংগ্রহ ও অভিজ্ঞতালাভ সম্বন্ধে জ্ঞান-সঞ্চয়ও সেইরূপ কতকটা আবশ্যক; কারণ, এরূপ জ্ঞান না থাকিলে আবদ্ধাবস্থায় পক্ষিগণের উপযোগী আহারাদি প্রদানের অভাবে বিষময় ফল ঘটিতে পারে। এই নিমিত্ত আমরা দেখিতে পাই যে, য়ুরোপীয় পক্ষিপালকগণ দলবদ্ধ হইয়া কতিপয় ক্লব বা সমিতির সৃষ্টি করিয়াছেন। তাঁহাদিগের উদ্দেশ্য, বনে বনে পরিভ্রমণপূর্ব্বক পক্ষীদিগের স্বাভাবিক জীবন পরিদর্শন। বলা বাহুল্য, এই প্রকার পরিদর্শনের ফলে যে সমস্ত অভিজ্ঞতা লাভ হয়, আবদ্ধ বিহঙ্গগুলির পালন-ব্যাপারে উহা নিয়োজিত হইয়া যথেষ্ট সুফল প্রসব করে। আমরা যথাক্রমে উল্লিখিত উপকরণসমূহের আলোচনায় প্রবৃত্ত হইলাম।

 সর্ব্বপ্রথমে পক্ষিপালক কিরূপ বা কোন্ জাতীয় পক্ষী পালন করিতে অভিলাষী আছেন, তাহা নির্দ্ধারণ করিয়া তাঁহাকে মনোনীত পাখীগুলির রক্ষণোপযোগি স্থান ঠিক করিতে হইবে। পাশ্চাত্য প্রথা অনুসারেপিঞ্জর ও পক্ষিগৃহ পক্ষিসংরক্ষণের স্থান সাধারণতঃ দ্বিবিধ—পিঞ্জর (cage) এবং বৃক্ষাদিশোভিত পক্ষিগৃহ (aviary)। সহজে স্থানান্তরিত করিতে পারা যায়, এরূপ বৃহৎ খাঁচাও aviary নামে অভিহিত হয়। এই দুই প্রকার আবাসস্থানের মধ্য হইতে যেটি পালকের পক্ষে অনায়াসলভ্য, অথচ যাহা তাহার নির্দ্ধারিত পক্ষীর সুখ ও স্বাস্থ্যের অনুকূল, তাহাই বাছিয়া লইতে হইবে। সচরাচর আমাদের দেশে যে সকল খাঁচা ব্যবহৃত হয়, তাহা আধুনিক বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে নির্ম্মিত খাঁচার তুলনায় অকিঞ্চিৎকর; বস্তুতঃ সেগুলি পক্ষিরক্ষণের আদৌ উপযোগী নহে। ইহার প্রধান কারণ এই যে, পরিষ্কার করিবার সদুপায় পিঞ্জরগুলিতে না থাকায় দুর্গন্ধ এবং কীটাণুর সৃষ্টি হইয়া পাখীদিগের স্বাস্থ্যহানি করে। এই অহিতকর পিঞ্জর-সমূহের মধ্যে প্রায়ই গোলাকার খাঁচার অধিক প্রচলন দেখা যায়। ইহাকে পক্ষিগণের প্রাণনাশক একপ্রকার যন্ত্র বলিলে অত্যুক্তি হইবে না; কারণ ইহার মধ্যে উৎপতন ও উল্লম্ফনের চেষ্টায় পাখীগুলি ঘূর্ণরোগাক্রান্ত হইয়া পড়ে এবং অচিরকালমধ্যে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। পিতলাদি কতিপয় ধাতুর দ্বারা নির্ম্মিত পিঞ্জর বাহ্যসৌন্দর্য্যশালী বটে, কিন্তু উহাদের মরিচা দ্বারা পক্ষীদিগের প্রাণনাশের সম্ভাবনা। এই নিমিত্ত তাহাদিগকে পরিত্যাগ করা কর্ত্তব্য। দারু-এবং লৌহতার-নির্ম্মিতপিঞ্জর কিরূপ হওয়া উচিত পিঞ্জর ব্যবহার করাই যুক্তিযুক্ত। পক্ষীর আয়তন ও স্বভাবের প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া পিঞ্জরের পরিমাণ নিরূপণ করিতে হইবে। কতিপয় পক্ষী ক্ষুদ্রকায় হইলেও অতিশয় চঞ্চল; ইহাদিগকে পিঞ্জরে রাখিতে হইলে পিঞ্জরটি ছোট হইলে চলিবে না; কারণ ইতস্ততঃ উল্লম্ফনের ফলে পিঞ্জরগাত্রে আঘাত লাগিয়া উহাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ক্ষতবিক্ষত হইবার সম্ভাবনা। অপর কতিপয় পক্ষী দীর্ঘকায় হইলেও স্থিরস্বভাব বশতঃ তাহাদিগকে অল্প-পরিসর পিঞ্জরের মধ্যে আবদ্ধ করা যাইতে পারে। কিন্তু তাহা হইলেও লক্ষ্য রাখিতে হইবে, যেন তাহাদিগের অঙ্গসঞ্চালনের কোনরূপ ব্যাঘাত না হয়; কারণ যথেষ্ট অঙ্গসঞ্চালন ব্যতীত পাখী কখনই জীবিত থাকিতে পারে না। এই প্রসঙ্গে পক্ষিতত্ত্ববিদ্ ডাক্তার ব্রেমের (Dr. Brehm) কথা স্বতঃই আমাদের মনে উদিত হয়—“Life and motion are in the case of the bird identical”। বলিলে অত্যুক্তি হইবে না যে, বিহঙ্গজাতির ক্ষুদ্র প্রাণ উহাদিগের অঙ্গসঞ্চালনরূপ উপাদানের সমষ্টিমাত্র। অঙ্গ-সঞ্চালনই পক্ষীদিগের আনন্দভাব প্রকাশ করিয়া থাকে।

 উক্ত প্রকারে পিঞ্জরের পরিমাণ নিরূপণ করিয়া উহার অভ্যন্তরে কতিপয় আনুষঙ্গিক দ্রব্যের স্থাপন একান্ত আবশ্যক। প্রথমতঃ পক্ষীটির পানীয় জল[১] ও খাদ্যের আধার রাখিবার স্থান এরূপভাবে নির্ম্মাণ করিতে হইবে, যেন অতি সহজে উহাদিগকে বাহির করিয়া পুনরায় পিঞ্জরাভ্যন্তরে স্থাপন করিতে পারা যায়; অর্থাৎ খাঁচার মধ্যে হাত না ঢোকাইয়া বাহির হইতে খাদ্য ও জলপাত্রগুলি রাখিবার ও বাহির করিবার উপায় থাকে। পাত্রগুলি উত্তমরূপে ধৌত হইলে, উহাদিগকে স্বচ্ছ সলিল ও পরিমিত পুষ্টিকর খাদ্যের দ্বারা পূর্ণ করিয়া পুনরায় স্ব স্ব স্থানে স্থাপন করিতে হইবে। উক্ত পাত্রসমূহের সন্নিবেশ ও বহিষ্করণের জন্য পিঞ্জরাভ্যন্তরে হস্তপ্রবেশ করাইলে পাখীগুলি অতিশয় ভীত হইয়া ছটফট করিতে থাকে, এবং পিঞ্জরগাত্রে আঘাত লাগিয়া উহাদের বিপৎপাতের আশঙ্কা উপস্থিত হয়। এই নিমিত্ত বাহির হইতে পাত্র-সমূহের ভিতরে বিন্যাস ও নিষ্ক্রামণের জন্য পিঞ্জরগাত্রেতন্মধ্যে খাদ্যপানীয়াদি-দ্রব্য-সংস্থাপন কয়েকটি ছিদ্রের[২] ব্যবস্থা থাকা উচিত; এবং ছিদ্রগুলির পরিমাণ খাদ্যাদিপাত্রের আয়তন অনুযায়ী হওয়া আবশ্যক; অর্থাৎ এরূপ হওয়া চাই, যাহাতে পাত্রগুলি সংলগ্ন হাতলের (handle) সাহায্যে আলমারির টানার (drawer) ন্যায় ইহার মধ্যে ঢুকাইতে এবং টানিয়া বাহির করিতে পারা যায়[৩]। (২য়) খাঁচার তলদেশের আবরণটি এরূপ ধাতুর দ্বারা নির্ম্মিত হওয়া উচিত, যেন ইহাতে আবর্জ্জনাদি পতিত হইলে দুর্গন্ধের সৃষ্টি না হয়; কারণ এই দুর্গন্ধে পক্ষীর স্বাস্থ্যনাশের সম্ভাবনা। খাদ্য ও জলপাত্রের ন্যায় উল্লিখিত প্রকারে এই আবরণটীকে সহজে বাহির করিবার উপায় থাকা একান্ত আবশ্যক। প্রতিদিন সকালে উহাকে পরিষ্কার করিয়া পুনরায় যথাস্থানে রাখিতে হইবে। (৩য়) কোন কোন জাতীয় পাখীর নিমিত্ত বালির বিশেষ আবশ্যক বোধে বালুকাপূর্ণ পাত্র পিঞ্জরের অভ্যন্তরে স্থাপন করিতে হইবে। অনেকে স্বতন্ত্র বালির পাত্র না রাখিয়া পিঞ্জরের তলদেশের আবরণটি বালুকাপূর্ণ করিয়া থাকেন। বালি রাখিবার প্রয়োজনীয়তা এই যে, ইহা পাখীর পরিপাকশক্তির সহায়তা করে। (৪র্থ) পিঞ্জরমধ্যে পক্ষীর উপবেশনোপযোগী দুইটি দাঁড়ের প্রয়োজন; এই দাঁড় ধাতুনির্ম্মিত না হইয়া নিম্বকাষ্ঠের হওয়া উচিত, কারণ এই কাষ্ঠে কীটাদি সঞ্চারের সম্ভাবনা নাই। দাঁড় দুইটির স্থূলতাপাখীর দাঁড় এরূপ হওয়া উচিত, যাহাতে পাখীটি অনায়াসে অঙ্গুলির দ্বারা উহাকে আয়ত্ত করিতে পারে; নচেৎ কোনও প্রকারে অঙ্গুলিতে ব্যথা জন্মিয়া গুরুতর উপসর্গাদি ঘটিবার সম্ভাবনা আছে। পিঞ্জরের ভিতরকার বিষয়গুলির সুবন্দোবস্ত যেরূপ নিপুণভাবে করিতে হইবে, বহির্দ্বার-নির্ম্মাণবিষয়েও তদনুরূপ যত্ন লওয়া একান্ত আবশ্যক। উক্ত দ্বার পিঞ্জরগাত্রে সংলগ্ন অবস্থায় ঊর্দ্ধদিকে উত্তোলন করিয়া উন্মুক্ত এবং অধোভাগে আকর্ষণ করিয়া আবদ্ধ করিবার পদ্ধতি সুকৌশলে সাধন করিতে হইবে। তাহা হইলে, পক্ষিপালক আবশ্যক মত উক্ত পিঞ্জর-দ্বার ঈষৎ উন্মুক্ত করিয়া অথবা ইচ্ছামত অবনমিত করিয়া এমনভাবে পিঞ্জরাভ্যন্তরে দ্রব্যাদি সন্নিবেশিত করিতে পারেন যে, অভ্যন্তরস্থ পক্ষীর পলায়নের কোন সুযোগ বা সম্ভাবনা থাকে না। কেবল বহির্দ্দিকে উন্মোচনশীল দরজা দ্বারা পালকের পক্ষিসংরক্ষণের ব্যবস্থা নিরাপদ হয় না।

 পাশ্চাত্য পণ্ডিতগণ বুদ্ধিকৌশলে বিভিন্নপ্রকার পক্ষিরক্ষণের অনুকূল পিঞ্জরসমূহের সৃষ্টি করিয়াছেন। উহাদের কতিপয় চিত্রপাখীর স্বভাবের অনুকূল ব্যবস্থা প্রদর্শিত হইল। পিঞ্জরগুলি যে নির্দ্দিষ্ট পক্ষিসমূহের সংরক্ষণের পক্ষে একান্ত আবশ্যক তাহা সহজে অনুমিত হয়। খঞ্জনপক্ষী স্বভাবতঃ স্নানপ্রিয়; চঞ্চল পদক্ষেপে জল আলোড়িত করিয়া লঘু ললিত ভঙ্গিতে পুচ্ছ কাঁপাইয়া ত্বরিত গতিতে সলিল-বক্ষে সঞ্চরণ করিতে ইহারা বড় ভালবাসে। এই নিমিত্ত দেখুন একটি সুবৃহৎ জলপাত্র ইহার নির্দ্দিষ্ট পিঞ্জরমধ্যে প্রদত্ত হইয়াছে; এবং যাহাতে সহজ উপায়ে ঐ পাত্রটি বাহির করিয়া তন্মধ্যস্থ অপরিষ্কৃত জল ফেলিয়া দিয়া পুনরায় স্বচ্ছ সলিল দ্বারা পূর্ণ করিয়া উক্ত পাত্রটি যথাস্থানে স্থাপন করিতে পারা যায় তদুপায়ও বিহিত হইয়াছে।

 সকল সময়ে কাঠে ঠোকর মারা কাঠঠোক্‌রা পাখীর স্বভাব। স্বভাবের সহিত স্বাচ্ছন্দ্যের নিকট-সম্বন্ধ; এই নিমিত্ত পাঠকবর্গ অনায়াসে উপলব্ধি করিতে পারিবেন যে, কি কারণে ইহার পিঞ্জরের একপার্শ্ব কাক (cork) গাছের বল্কল দ্বারা আচ্ছাদিত করা হইয়াছে। ইহাকে কাষ্ঠ-নির্ম্মিত পিঞ্জরে রাখিতে হইলে পিঞ্জরের অভ্যন্তর দস্তার চাদরের (Zinc sheet) দ্বারা আবৃত করিতে হইবে; নচেৎ ইহা ঠোকর দ্বারা কাষ্ঠমধ্যে ছিদ্র করিয়া অকস্মাৎ উড়িয়া পলাইতে পারে।

 লার্ক (lark) জাতীয় পক্ষীদিগের মধ্যে কতকগুলি প্রকারভেদে বা শ্রেণীগত পার্থক্য হেতু শ্যামল প্রান্তরে, কতকগুলি বালুকাময় মরুভূমিতে বিচরণ করিতে ভালবাসে। স্বভাবতঃ ইহারা ভূমিতলে অবস্থান করে এবং ভূগর্ভে নীড়নির্ম্মাণ পূর্বক তন্মধ্যে ভিম্বপ্রসব ও শাবকোৎপাদন করিয়া থাকে। বৃক্ষশাখায় অবস্থান করিতে ইহারা অনভ্যস্ত। এই নিমিত্ত ইহাদিগের খাঁচার মধ্যে দাঁড়ের ব্যবস্থা না করিয়া ঘাসের চাপড়া কিংবা বালুকা রক্ষা করিবার স্থান নির্দ্দিষ্ট

১। “ভরত” বা lark জাতীয় পক্ষীর পিঞ্জর
২। কাঠঠোক্‌রা পাখীর খাঁচা
৩। খঞ্জন পক্ষীর পিঞ্জর
৪। ক্ষুদ্র পাখীদের খাঁচা
 
[পৃঃ ২৪

হইয়াছে এবং পূর্ব্বোক্ত টানার (drawer) সাহায্যে ঘাসের চাপড়া কিংবা বালুকা বহিরানয়নপূর্ব্বক পরিষ্কার করিয়া অনায়াসে তদভ্যন্তরে সংস্থাপন করিবার উপায় ও বিহিত হইয়াছে। পিঞ্জরমধ্যে উহাদের স্নানের নিমিত্ত জলপাত্র রাখিবার আবশ্যকতা নাই; কারণ উহারা মৃত্তিকা বা বালুকারাশিতে পতিত হইয়া তদুপরি অঙ্গঘর্ষণ দ্বারা গাত্রমল বিদূরিত করিয়া থাকে।

 এস্থলে যে কয়েকটি পিঞ্জর-চিত্র প্রদত্ত হইয়াছে তাহাদের মধ্যে ক্ষুদ্রকায় বিহঙ্গগণের পক্ষে অতি উপাদেয় পিঞ্জরটির বাহ্যাভ্যন্তরীণ কারুকৌশল নিরীক্ষণ করিলে পাঠকবর্গের সহজে বোধগম্য হইবে যে, খাঁচার ভিতরে খাদ্যাদিপাত্র রাখিবার নিমিত্ত পূর্ব্বোক্ত টানার সাহায্য না লইয়া অপর একটি সুন্দর উপায় উদ্ভাবিত হইয়াছে। তাঁহারা দেখিতে পাইবেন, পিঞ্জরগাত্রে কতিপয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্র এরূপে রচিত হইয়াছে যাহাতে পিঞ্জরাভ্যন্তরস্থ পক্ষী সুধু চঞ্চুপুটের বিনির্গম দ্বারা খাঁচার বহির্ভাগে ছিদ্রগুলির মুখে সুকৌশলে স্থাপিত পাত্র-সমূহ হইতে খাদ্যাদি গ্রহণ করিতে সমর্থ হয়। পাত্রগুলিতে একটি আবরণ সংলগ্ন থাকায় বাহির হইতে কোনও পক্ষী খাদ্যাদি গ্রহণ বা অপচয় করিতে পারে না; পরন্তু সেগুলি বহির্দ্দেশে সন্নিবেশিত থাকায় অভ্যন্তরস্থ পক্ষীর আবর্জ্জনা-সংমিশ্রণে খাদ্যাদি দূষিত হইবার কিছুমাত্র সম্ভাবনা নাই।

 বলা বাহুল্য, উল্লিখিত প্রত্যেক পিঞ্জরই একটি পাখী বা এক জাতীয় পক্ষি-মিথুন রাখিবার অনুকূল। বিভিন্ন জাতীয় বহুবিধ পক্ষীর রক্ষণোপযোগি স্থান-সংবিধানের উপায় একমাত্রপক্ষিগৃহের আবশ্যকতা aviary বা বৃক্ষাদি-শোভিত অসঙ্কীর্ণ পক্ষিগৃহ। ইহার অভ্যন্তরে বৃক্ষাদির সুবিন্যাস এবং বায়ু ও আলোকের যথেষ্ট সদ্ভাবপ্রযুক্ত পক্ষিগণের ইচ্ছামত সঞ্চরণ ও অবস্থান হেতু স্বাস্থ্যভঙ্গের কিছুমাত্র সম্ভাবনা না থাকায়, এই পক্ষি-গৃহের প্রয়োজনীয়তা অল্পপরিসর পিঞ্জর অপেক্ষা এত অধিক হইয়া দাঁড়াইয়াছে। নির্ভীক এবং উৎফুল্ল চিত্তে পাখীরা ইহার মধ্যে গান গাহিয়া জীবন যাপন করে; এমন কি অতি চঞ্চল-স্বভাব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পক্ষি-মিথুনও (যাহাদিগের পিঞ্জরমধ্যে শাবকোৎপাদনের কোনও সম্ভাবনা নাই) বিভিন্ন ঋতুতে সুকৌশলে নীড়-নির্ম্মাণপূর্ব্বক তন্মধ্যে ডিম্বপ্রসব ও সন্তানোৎপাদন করিয়া থাকে। পক্ষিপালকমাত্রেরই এইরূপ পক্ষিগৃহ চির আকাঙ্ক্ষিত হইলেও বহুব্যয়-সাপেক্ষ বলিয়া সকলের পক্ষে ইহা সুসাধ্য নহে। যে সমস্ত উপকরণসামগ্রী অল্পপরিসর পিঞ্জরের নিমিত্ত আবশ্যক হয়, এই পক্ষিগৃহে তদপেক্ষা অধিক সাজসজ্জার প্রয়োজন। এই সামগ্রীসমূহ আহরণ করিবার পূর্ব্বে পালককে পাখীদিগের বাসভবন নির্ম্মাণের উপযোগী এমন একটি জায়গা বাছিয়া লইতে হইবে, যথায় পাখীগুলি ইচ্ছামত বায়ু এবং পরিমিত তাপ উপভোেগ করিয়া সুখে কালযাপন করিতেগৃহরচনার স্থান-নির্ব্বাচন ও গঠনপ্রণালী পারে। পক্ষিগৃহমধ্যে আলোক ও বায়ুসঞ্চারের ব্যবস্থা করিতে গিয়া পালকের স্মরণ রাখা উচিত যে, ঝড়বৃষ্টি এবং প্রচও উত্তাপের সময় পাখীরা আশ্রয় অভাবে যাহাতে ক্লেশ অনুভব না করে, গৃহ-নির্ম্মাণকালে তদ্‌বিষয়ে তাঁহাকে মনোযোগী হইতে হইবে। সাধারণতঃ পালকের নিজবাটীর কোনও দেয়াল পক্ষিগৃহের উত্তর দিকের প্রাচীর-স্বরূপ রাখিয়া পক্ষিনিকেতন নির্ম্মাণ করিতে পারিলে ভাল হয়; এই পক্ষিগৃহের দক্ষিণ এবং পূর্ব্ব দিক্ প্রাচীর-সংযুক্ত করিয়া কেবলমাত্র সূক্ষ্মছিদ্রবিশিষ্ট লৌহের জাল দ্বারা বেষ্টিত রাখা শ্রেয়; তাহা হইলে বিশুদ্ধ দক্ষিণ বায়ু অবাধে গৃহমধ্যে প্রবেশ লাভ করিয়া এবং সূর্য্যরশ্মি প্রাতঃকাল হইতে তন্মধ্যে সঞ্চারিত হইয়া পাখীদিগের স্বাস্থ্যের বিশেষ উন্নতি সাধন করিবে। যদি পালকের বাস-ভবনের কোনও প্রাচীর দ্বারা পক্ষিগৃহের উত্তর দিক্‌ আবৃত করার সম্ভাবনা না থাকে, তাহা হইলে ঐ দিক ইষ্টকের গাঁথুনি বা লৌহের চাদর দ্বারা আচ্ছাদিত রাখা কর্ত্তব্য। ঐরূপ, গৃহের ছাদটির কিয়দংশ টালির কিংবা তক্তার আচ্ছাদনে আবৃত রাখিতে হইবে; কারণ ঝড়বৃষ্টির ও প্রখর উত্তাপের সময় পাখীরা এই আবৃত প্রদেশে আশ্রয় পাইলে বিপৎপাতের সম্ভাবনা থাকিবে না। বৃক্ষের কতিপয় কর্ত্তিত শাখা ছাদে সংলগ্ন করিয়া পাখীগুলির অবস্থানোপযোগী দাঁড়ের ন্যায় ঐস্থানে ঝুলাইয়া রাখা উচিত। পক্ষিগৃহের অনাবৃত পার্শ্বদেশগুলি (অর্থাৎ উত্তর ব্যতীত অপরাপর দিক্‌সমূহ এবং ছাদের অনাচ্ছাদিত অপরাংশ) লৌহের জাল দ্বারা সর্ব্বতোভাবে বেষ্টিত করিতে হইবে। সর্পমূষিকাদি হিংস্র প্রাণী গর্ত্ত করিয়া গৃহমধ্যে প্রবিষ্ট হইতে না পারে, তন্নিমিত্ত পক্ষীদিগের আবাসগৃহের মেজে ইষ্টকাদি দ্বারা পাকা করিয়া গাঁথা আবশ্যক।

 কোন কোন পক্ষিপালক এইরূপে স্বতন্ত্র পক্ষিগৃহ নির্ম্মাণ না করিয়া স্ব স্ব বাটীর বারান্দার কতক অংশ জাল দ্বারা বেষ্টিত করিয়া এবং উহার সম্মুখস্থ মুক্ত প্রাঙ্গণ বা উদ্যানের কিয়দংশ ঐ প্রকারে আবৃত করিয়া পক্ষিগৃহনির্ম্মাণে প্রয়াস পাইয়া থাকেন। এইরূপ গৃহ নির্ম্মিত হইলে পাখীগুলি যে ঝড়বৃষ্টির সময় বারান্দার আচ্ছাদিত প্রদেশে নিরাপদে আশ্রয় লইতে পারিবে সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। উল্লিখিত গৃহ-রচনায় পক্ষিপালকের ব্যয় সংক্ষেপ হয় বটে, কিন্তু এই প্রকার ব্যয়-সংক্ষেপ করিতে গিয়া তিনি যেন বিস্মৃত না হন যে, উত্তর চাপা ও দক্ষিণ খোলা বারান্দাই এ বিষয়ে একমাত্র ব্যবহার্য্য। য়ুরোপ প্রভৃতি শীতপ্রধান দেশে পাখীদিগকে ভীষণ শীতের প্রকোপ হইতে রক্ষা করিবার নিমিত্তশীতপ্রধানদেশের বিশিষ্ট ব্যবস্থা গৃহমধ্যে সুকৌশলে যন্ত্রসংযোগে অগ্নির উত্তাপ প্রদত্ত হইয়া থাকে। আমাদিগের দেশেও সময়ে সময়ে শীতের প্রাবল্য ও প্রচণ্ড বর্ষার আক্রমণ হইতে পাখীগুলিকে রক্ষা করিবার জন্য এরূপ কোন পন্থা অবলম্বন করা উচিত, যাহাতে উহারা উক্ত প্রকার উপসর্গাদির দ্বারা উপদ্রুত হইয়া অকালে মরিয়া না যায়। যদিও এখানে তাপদায়ক কোনরূপ যন্ত্র আবশ্যক হয় না বটে, তথাপি দারুণ শীত ও বর্ষার সময় পক্ষীদিগের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের নিমিত্ত শীতনিবারক পর্দ্দা কিংবা অন্য কোনও আবরণের দ্বারা পক্ষিগৃহ আবৃত রাখার ব্যবস্থা করা উচিত।

 এইরূপে পক্ষিগৃহ নির্ম্মিত হইলে পর উহার আভ্যন্তরীণ উপকরণ-সামগ্রীগুলি যাহাতে গৃহমধ্যে সুবিন্যস্ত হয়, পালককে তদ্বিষয়ে মনোেযোগী হইতে হইবে। এই সমস্ত অত্যাবশ্যক উপকরণ পূর্ব্বে বর্ণিত হইয়াছে;গৃহের সাজসজ্জা ও খাদ্যাদি উপকরণ এখন এসম্বন্ধে আরও দুই একটী কথা বলা যুক্তিযুক্ত মনে করি। গৃহমধ্যে ঘন লতা ও বৃক্ষাদি রোপণ করিয়া, কৃত্রিম হ্রদ, পর্ব্বত ও প্রস্রবণাদি নির্ম্মাণ করিয়া এবং পাখীদিগের স্বাস্থ্যের অনুকূল বালুকা ও শ্যামল তৃণের সমাবেশ দ্বারা গৃহটী এরূপে সজ্জিত রাখা আবশ্যক, যাহাতে পাখীগুলির মনে ইহা সহজে বনস্থলীর ভাব জাগাইয়া দেয়। বহুবিধ কীট-পতঙ্গ লতায় ও পুষ্পে অসঙ্কোচে আশ্রয় লইয়া পাখীগুলির রুচিকর খাদ্যরূপে পরিণত হইবে এবং বৃক্ষগুলি ইহাদিগের সুবিধামত নীড়-নির্ম্মাণাদি গার্হস্থ্য ব্যাপারে সবিশেষ সহায়তা করিবে। পক্ষীদিগের স্বভাব এবং সংখ্যা অনুযায়ী খাদ্যাদির সুব্যবস্থা করা আবশ্যক; সেগুলির বিন্যাস এরূপ স্থানে করিতে হইবে, যথায় পিপীলিকাদি ক্ষুদ্র কীটের অথবা রৌদ্র ও ঝড়বৃষ্টির দ্বারা ইহারা নষ্ট বা দূষিত না হয়। গৃহমধ্যে বহুবিধ পক্ষীর সংরক্ষণ হেতু খাদ্য ও খাদ্যপাত্রগুলির স্বল্পতা হইলে উহাদিগের মধ্যে পরস্পর তুমুল বিবাদ ঘটিবার সম্ভাবনা; এই নিমিত্ত অনেকগুলি পাত্র প্রচুর খাদ্যের দ্বারা পূর্ণ করিয়া গৃহমধ্যে নানা স্থানে রাখিতে হইবে, যাহাতে ছোট বড় সকল রকমের পাখী অবাধে ভোজন করিতে পারে। ইহাদিগের পান ও স্নানের নিমিত্ত জলপাত্রেরও প্রয়োজন। উল্লিখিত কৃত্রিম হ্রদে এই উভয়বিধ কার্য্যের সমাধা হইতে পারে; কিন্তু লক্ষ্য রাখা উচিত যেন হ্রদটি গভীর না হয়, কারণ তাহা হইলে ক্ষুদ্র পক্ষীগুলির পক্ষে ইহার মধ্যে অবতরণ করিয়া স্নানের বিঘ্ন ঘটিবে এবং অনেক সময়ে স্নান করিতে করিতে হ্রদমধ্যে সহসা পড়িয়া গিয়া ডুবিয়া মরিবার সম্ভাবনা থাকিবে।

 উল্লিখিত সাজসজ্জার প্রতি পক্ষিগৃহস্বামীর যেরূপ মনোযোগী হওয়া আবশ্যক, তদ্রূপ প্রতিদিবস যাহাতে পক্ষিগৃহের অভ্যন্তরগৃহমার্জ্জন ও প্রক্ষালন ও তলদেশ সুচারুরূপে ধৌত এবং পরিমার্জ্জিত হয় সে দিকে দৃষ্টি রাখিতে হইবে।


  1. কেহ কেহ পানীয় জলের মাত্রা বৃদ্ধি করিয়া দিয়া তাহাতে পাখীর পান ও স্নান একযোগে এই উভয়বিধ কার্য্য সমাধা করিবার ব্যবস্থা করেন। ইহার দোষ এই যে, স্নানের পর জল দূষিত হয় বলিয়া ইহা পরে অব্যবহার্য্য হইয়া পড়ে। এই নিমিত্ত দুইটি স্বতন্ত্র জলাধার রাখা দরকার এবং স্নানের পর স্নানপাত্রটী বাহির করা আবশ্যক।
  2. পিঞ্জরগাত্রের তলদেশের ঈষৎ ঊর্ধ্বভাগে এরূপভাবে ছিদ্রগুলি করিতে হইবে, যাহাতে পাত্রগুলিকে ভিতরে ঢোকান যায় এবং সেগুলি খাঁচার তলদেশস্থ আবরণের সহিত সংলগ্ন হয়; নচেৎ উহারা ঠেস বা আশ্রয় অভাবে উল্টাইয়া পড়িবে। পাত্রসমূহের বহিষ্করণের সঙ্গে সঙ্গে ছিদ্রগুলির দ্বারদেশ অতি সহজে আবৃত করিবার উপায় বিধান করিতে হইবে; নচেৎ পাত্রসমূহ বহিষ্কৃত হইলে পিঞ্জরাভ্যন্তরস্থ পাখীগুলি উড়িয়া পলাইতে পারে।
  3. বৃক্ষাদিশোভিত পক্ষিগৃহের (aviary) রচনাকালে কিন্তু এই সমস্ত খুঁটিনাটি লইয়া ব্যস্ত থাকিবার দরকার হয় না, কারণ সেখানে পক্ষীগুলি প্রচুর জায়গা পাইয়া স্বচ্ছন্দে ইতস্ততঃ সঞ্চয়ণ করিতে পারে এবং গৃহমধ্যে পাত্রগুলি রাখিবার ও বাহির করিবার সময় তাহারা ত্রস্ত হয় না।