কুশাসনে উপবেশনপূর্বক মুখশুদ্ধি করিয়া কৰ্মচারিগণকে বিষয়কর্মের আজ্ঞা দিতেন: তাহারা সেই সমস্ত আদেশ লিখিয়া লইত। তৃতীয় প্রহরের পর পুনর্বার ভাষাতে পুরাণশ্রবণ করিতেন। দুই দও বেলা থাকিতে পুরাণশ্রবণ শেষ হইত। সেই সময়ে কর্মচারিগণ র্তাহার আদেশানুযায়ী লিখনাদি প্রস্তুত করিয়া স্বাক্ষর করাইতে আসিত। রানী এই লিখনাদি শুনিয়া তাহাতে মুদ্রাকন করিয়া দিতেন। সায়ংকালে পুনর্বার গঙ্গাদর্শন ও গঙ্গাতে ঘৃতপ্রদীপ দিয়া, বাসভবনে আসিয়া রাত্রি চারি দণ্ড পর্যন্ত মাল৷ জপ করিতেন; তাহার পর জলগ্রহণাস্তে দেওয়ান-দপ্তরে বিষয়সংক্রান্ত কার্যের আজ্ঞা দিতেন। রাত্রি এক প্রহরের সময় প্রজাদিগের প্রার্থনা শুনিয়া বিচার করিতেন; অবশেষে পৌরজন কে কিভাবে থাকে, অনুসন্ধান লইষা, রাত্রি দেড় প্রহরের সময় শয্যায়
গমন করিতেন।
রানী ভবানী বড়নগর ও তাহার নিকটস্থ অন্যান্য দেবালয়ের জন্য প্রায় লক্ষ টাকার বৃত্তি নির্দেশ করিয়া দেন। এই সমস্ত অর্থ দেবকর্যে ব্যয়িত হইত। তিনি তাহ। হইতে এক কপর্দকও গ্রহণ করিতেন না। তাহার নিজের ও র্তাহার সহচরী বিধবামণ্ডলীর জন্য অবশেষে তাহাকে গবর্নমেন্টের বৃত্তির উপর নির্ভর করিতে হয়। প্রথমতঃ তিনি মাসিক ৮ooo টাকা বৃত্তি পাইতেন; পরে উহা কমিতে কমিতে ১০oo টাকায় পরিণত হয়। যিনি নিজে লক্ষাধিক মুদ্রার সম্পত্তি দেবসেবায় নির্দেশ করিয়াছিলেন, তিনি যে কিজন্য গবর্ণমেন্টের নিকট বৃত্তিপ্রাথিনী হইলেন, ইহা নিতান্ত রহস্যময় সন্দেহ নাই। দেবতার জন্য যে সম্পত্তি অপিত হইয়াছে, তাহার দ্বারা তিনি আত্মোদরপূরণের পক্ষপাতিনী ছিলেন না, ইহা ব্যতীত আর কি বলা যাইতে পারে?
এইরূপে কঠোর ব্রহ্মচর্য অবলম্বনপূর্বক দেবসেবায়, ব্রাহ্মণসেবায়, ও দীনপ্রতিপালনে আপনার জীবনকে উৎসর্গীকৃত করিয়া রানী ভবানী ৭৯ বৎসর বয়সে বড়নগরে ভাগীরথীতীরে বিশ্বজননী ভবানীসহ চিরসম্মিলিত হন। যিনি হিন্দু বিধবার অত্যুচ্চ আদর্শ দেখাইয়া, স্বীয় পবিত্র নামকে প্রাতঃস্মরণীয় করিয়া গিয়াছেন, তাহার সেই আদর্শ দিন দিন বঙ্গভূমি হইতে লয় পাইতে বসিয়াছে। বঙ্গদেশে কত রাণী, কত মহারানী জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, কিন্তু রানী ভবানীর ন্যায় এমন অপূর্ব আদর্শ আর কখনও শুনিতে বা দেখিতে পাওয়া যায় নাই। বর্তমান সময়ে একজনমার র্তাহার আদর্শ চরিত্রের অনুকরণে আপনার পবিত্র নাম প্রচার করিয়া গিয়াছেন। র্তাহার নাম মহারানী শরৎসুন্দরী। সেই দ্বিতীয়া ভবানীর পবিত্র চরিত্র কিছুদিনের জন্য বঙ্গভূমিতে হিন্দুবিধবাচরিত্রের আদর্শ দেখাইয়াছিল। রানী ভবানীর সহিত তারাও বড়নগরে বাস করিতেন। বড়নগরে তাহার স্থাপিত দেবমন্দিরও আছে। রাজা রামকৃষ্ণ মধ্যে মধ্যে বড়নগরে আসিয়া বাস করিতেন। তিনি বড়নগরের যে স্থানে সাধনাসন করিয়াছিলেন, অদ্যপি তাহার চিহ্ন বর্তমান রহিয়াছে। রামকৃষ্ণ প্রতিদিন বড়নগর হইতে কিরীটেশ্বরীতে সাধনার্থ গমন করিতেন বলিয়া প্রবাদ আছে। রানী ভবানীর জীবিতাবস্থাতেই রামকৃষ্ণের জীবলীলার অবসান হয়।