রাণী না খুনি? (প্রথম অংশ)/তৃতীয় পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

তৃতীয় পরিচ্ছেদ।

 গবর্ণমেণ্টের যে কার্য্য সম্বন্ধে আমাকে নিযুক্ত হইতে হইয়াছিল, সেই কার্য্য শেষ করিতে আমার প্রায় দুই তিনদিবস অতিবাহিত হইয়া গেল। সেই কার্য্য সমাপনান্তে আমি থানায় প্রত্যাবর্ত্তন করিয়া, যে কর্ম্মচারীর হস্তে রামজীলাল সম্বন্ধীয় অনুসন্ধানের ভার অর্পণ করিয়া গিয়াছিলাম, তাঁহাকে ডাকিলাম। ডাকিয়া জিজ্ঞাস করিলাম, “আমি যে কার্য্যের ভার আপনার হস্তে অর্পণ করিয়া গিয়াছিলাম, সেই কার্য্য আপনি কতদূর সম্পন্ন করিতে সমর্থ হইয়াছেন?”

 কর্ম্মচারী। অনুসন্ধান প্রায় আমি একরূপ শেষই করিয়া রাখিয়াছি, এখন আসামীকে ধরিতে পারিলেই হইল।

 আমি। আসামী কে?

 কর্ম্মচারী। রামজীলাল।

 আমি। তাহার অপরাধ?

 কর্ম্মচারী। অপরাধ, তাহার মনিবের টাকা আত্মসাৎ করা।

 আমি। তাহা হইলে ইহাই সাব্যস্ত হইয়াছে যে, রামজীলাল সেই সকল জহরত লইয়া পলায়ন করিয়াছে?

 কর্ম্মচারী। না, সেই সকল জহরত লইয়া রামজীলাল পলায়ন করে নাই। সেই সকল জহরত বিক্রয় করিয়া তাহার মূল্য লইয়া রামজীলাল পলায়ন করিয়াছে।

 আমি। এ সম্বন্ধে বেশ প্রমাণ পাইয়াছেন?

 কর্ম্মচারী। তাহার বিপক্ষে বেশ প্রমাণ আছে; মাজিষ্ট্রেট সাহেবও তাহার কতক প্রমাণ গ্রহণ করিয়া রামজীলালের নামে ওয়ারেণ্ট বাহির করিয়া দিয়াছেন।

 আমি। ভালই হইয়াছে। সেই ওয়ারেণ্ট এখন কোথায়?

 কর্ম্মচারী। আমার নিকটেই আছে।

 আমি। সেই ওয়ারেণ্ট আমাকে প্রদান করিবেন। তাহাকে ধরিবার নিমিত্ত আমি একবার চেষ্টা করিয়া দেখিব; আপনিও আপনার চেষ্টার ত্রুটি করিবেন না।

 কর্ম্মচারী। সেই ওয়ারেণ্টখানি এখনই আমি আপনাকে প্রদান করির কি?

 আমি। এখনই আমাকে প্রদান করিতে হইবে না; কিন্ত আপনি কিরূপ অনুসন্ধান করিয়াছেন, এবং রামজীলালের বিপক্ষে কিরূপ প্রমাণ সংগৃহীত হইয়াছে, তাহা আমি পূর্ব্বে একবার জানিতে ইচ্ছা করি।

 কর্ম্মচারী। উত্তম কথা। আমি যাহা যাহা করিয়াছি, তাহা আপনাকে বলিতেছি। আমি প্রথমতঃ কালীবাবুর নিকট সমস্ত কথা শুনিয়া তাহার পর অপরাপর লোকের নিকট অনুসন্ধান করি।

 আমি। কালীবাবুর সন্ধান করিয়া তাঁহাকে কিরূপে বাহির করিতে সমর্থ হইলেন?

 কর্ম্মচারী। কালীবাবুর অনুসন্ধান করিতে আমার কিছুমাত্র কষ্ট হয় নাই। আমি প্রথমতঃ দরখাস্তকারীর দোকানে গমন করি। কালীবাবুকে দেখিলে চিনিতে পারিবে, এইরূপ একটী লোক সঙ্গে করিয়া কালীবাবুর অনুসন্ধান করিবার মানসে, সেই স্থান হইতে আসিতেছিলাম, সেই সময় পথিমধ্যে হঠাৎ কালীবাবুকে দেখিতে পাইয়া সেই ব্যক্তি আমাকে দেখাইয়া দেয়।

 আমি। কালীবাবু কি কার্য্য করিয়া থাকেন?

 কর্ম্মচারী। তাহা আমি জানি না, জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলিয়াছিলেন যে, তিনি দালালী কার্য্য করিয়া থাকেন।

 আমি। কালীবাবু প্রকৃতই দালালী কার্য্য করেন কি না, সে সম্বন্ধে আপনি কোনরূপ অনুসন্ধান করিয়াছেন কি?

 কর্ম্মচারী। না।

 আমি। তিনি থাকেন কোথায়?

 কর্ম্মচারী। তিনি যেখানে থাকেন, তাহা আমি জানি; আমি নিজে গিয়া তাঁহার বাড়ী দেখিয়া আসিয়াছি।

 আমি। কিরূপ বাড়ীতে তিনি থাকেন?

 কর্ম্মচারী। দোতালা পাকা বাড়ী।

 আমি। তিনি সেই বাড়ীতে একাকী বাস করিয়া থাকেন কি?

 কর্ম্মচারী। না, সেই বাড়ীতে অনেকগুলি স্ত্রীলোক থাকে, তাহাদিগের মধ্যে একখানি ঘরে তিনিও বাস করেন।

 আমি। সেই স্ত্রীলোক কি প্রকারের, গৃহস্থ, না বেশ্যা?

 কর্ম্মচারী। বেশ্যা।

 আমি। তাহা হইলে যে গৃহে কালীবাবু থাকেন, সেই গৃহেও বোধ হয়, একজন বেশ্যা বাস করিয়া থাকে?

 কর্ম্মচারী। হাঁ, একটী বেশ্যাকে লইয়া কালীবাবু সেই বাড়ীতেই থাকেন।

 আমি। কালীবাবুর সহিত আপনার সাক্ষাৎ হইলে তিনি আপনাকে কি বলিলেন?

 কর্ম্মচারী। আমি তাঁহাকে দেখিয়াই তাঁহাকে একবারে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘আপনি রামজীলাল নামক এক ব্যক্তির মারফত যে সকল জহরত আনিয়াছিলেন, তাহা এখন আপনার নিকট আছে, কি বিক্রয় করিয়া ফেলিয়াছেন?’ উত্তরে তিনি কহিলেন, “যাহার নিমিত্ত সেই সকল জহরত আনা হইয়াছিল, তিনি তৎক্ষণাৎ সেই সকল জহরত গ্রহণ করিয়াছেন, এবং সেই প্রেরিত লোক মারফত সমস্ত টাকাও প্রদান করিয়াছেন। টাকা লইয়া রামজীলাল তৎক্ষণাৎ সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিয়াছেন। সেই সকল জহরত বিক্রয় করিয়া আমার ন্যায্য যে কিছু দালালী প্রাপ্য হয়, তাহার কিয়দংশ তিনি আমাকে প্রদান করিয়া গিয়াছেন, এবং বলিয়া গিয়াছেন, দুই একদিবসের মধ্যে আরও কতকগুলি জহরত লইয়া তিনি আসিবেন, সেই সময় আমার দালালীর অবশিষ্ট যাহা প্রাপ্য আছে, তাহা প্রদান করিয়া যাইবেন। কিন্ত আজ পর্য্যন্ত তিনি আর প্রত্যাবর্ত্তন করিলেন না, বা আমার ন্যায্য পাওনাগুলিও পাঠাইয়া দিলেন না; আমিও নানা ঝঞ্ঝাটে আর সেই দোকানে গমন করিতে পারি নাই।”

 আমি। আপনি কালীবাবুকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন কি যে, সেই সকল জহরত কালীবাবু নিজে খরিদ করিয়াছিলেন, কি অপর কোন লোক খরিদ করিয়াছিল?

 কর্ম্মচারী। জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম। উত্তরে কালীবাবু আমাকে এই বলিয়াছিলেন যে, “রাজার মত কোন একজন জমিদার সেই জহরত খরিদ করিয়াছেন।”

 আমি। সেই রাজা বা জমিদার কে?

 কর্ম্মচারী। কালীবাবু তাহা আমাকে বলেন নাই।

 আমি। তিনি যে বাড়ীতে থাকেন, সেই বাড়ী আপনাকে দেখাইয়া দিয়াছিলেন কি?

 কর্ম্মচারী। না, তাঁহার বাড়ীও আমাকে দেখাইয়া দেন নাই।

 আমি। তাহা হইলে জহরতগুলি কোন্‌ স্থানে তিনি গ্রহণ করেন, এবং উহার মূল্যই বা কোন্‌ স্থানে তিনি প্রদান করেন?

 কর্ম্মচারী। কালীবাবু আমাকে কেবল ইহাই বলেন যে, যে বাড়ীতে কালীবাবু থাকেন, সেই বাড়ীর কোন একটা স্ত্রীলোকের গৃহে সেই জমিদার মহাশয় আগমন করিতেন। সেই স্থানে কালী বাবুর সহিত তাঁহার পরিচয় হয়, এবং কতকগুলি জহরত আনিবার নিমিত্ত সেই স্থানে বসিয়াই কালীবাবুকে আদেশ করেন। তাঁহারই আদেশ মত কতকগুলি জহরত আনা হয়। সেই সকল জহরতের সঙ্গে রামজীলাল আগমন করেন, এবং সেই স্ত্রীলোকের গৃহে বসিয়াই তিনি সেই সকল জহরত খরিদ করেন, ও রামজীলালের হস্তে উহার মূল্য প্রদান করেন।

 আমি। একজন রাণী যে জহরত খরিদ করিতে গিয়াছিলেন, তাহা হইলে সেই রাণী কে?

 কর্ম্মচারী। রাণী যে কে, তাহা কালীবাবু আমাকে স্পষ্ট করিয়া বলেন নাই। কেবল তিনি আমাকে এইমাত্র বলিয়াছিলেন, যে স্ত্রীলোকটীর গৃহে তিনি আগমন করিতেন, সেই স্ত্রীলোকটীকে সঙ্গে লইয়া তিনি জহরত খরিদ করিতে বাজারে গমন করেন। তিনি যে জুড়িতে ছিলেন, সেই স্ত্রীলোকটীও সেই জুড়িতে ছিলেন বলিয়া, লোক-লজ্জার ভয়ে তিনি গাড়ির “ঘেরাটোপ” ফেলিয়া সেই স্ত্রীলোকটার সহিত বাজারে আগমন করেন। তাঁহার ইচ্ছা ছিল, তিনি নিজে দোকানে বসিয়া জহরতগুলি দেখিয়া শুনিয়া পসন্দ করিয়া লইবেন; কিন্তু দোকানে গমন করিয়া, গাড়ি হইতে বাহির হইবার সময় দেখিতে পান, সেই দোকানে একটী লোক বসিয়া আছেন। বোধ হয়, সেই লোকটীই সেই দোকানের মালিক। সেই লোকটাকে তিনি পূর্ব্ব হইতে চিনিতেন। কারণ সেই ব্যক্তির সহিত তাঁহার পিতার সবিশেষরূপ পরিচয় আছে। তিনি পাছে তাঁহার চরিত্রের কথা তাঁহার পিতার নিকট বলিয়া দেন, এই ভয়ে তিনি আর গাড়ি হইতে নামিতে সাহসী হন নাই, এবং সেই স্থানে আত্ম-প্রকাশ হইয়া পড়িবে, এই ভয়ে সেই স্ত্রীলোকটীকে রাণী বলিয়া পরিচয় প্রদান করিতে কালীবাবুকে বলিয়া দেন, ও তাহাকেই জহরতগুলি দেখাইয়া খরিদ করিতে বলেন। কালীবাবু, নামে জহরতগুলি রাণীজিকে দেখান; কিন্ত প্রকৃত পক্ষে সেই জমিদার-পুত্ত্রই সেই গাড়ির ভিতর হইতে জহরতগুলি দেখিয়া পসন্দ করেন, এবং পুনরায় ভাল করিয়া দেখিয়া উহার মূল্য প্রদান করিবেন, বিবেচনা করিয়া, জহরতগুলি কালীবাবুর বাসায় লইয়া যাইবার নিমিত্ত কালীবাবুকে সেই স্থানে রাখিয়াতাঁহারা প্রস্থান করেন। কালীবাবু সেই সকল জহরত রামজীলালের মারফত তাঁহার বাড়ীতে লইয়া যান। সেই স্থানে জমিদার-পুত্ত্র পুনরায় জহরতগুলি ভাল করিয়া দেখেন, এবং পরিশেষে রামজীলালের হস্তে উহার মূল্য প্রদান করিয়া জহরতগুলি গ্রহণ করেন।

 আমি। কালীবাবু যে সকল কথা বলেন, তাহাদের পোষকতায় আর কোন প্রমাণ পাইয়াছিলেন কি?

 কর্ম্মচারী। পাইয়াছিলাম।

 আমি। কি?

 কর্ম্মচারী। যাহার গৃহে বসিয়া সেই সকল জহরত গ্রহণ করা হয়, এবং তাহার মূল্য প্রদান করা হয়, সেই স্ত্রীলোকটীও ঠিক সেই কথাই বলে।

 আমি। সেই স্ত্রীলোকটী কে?

 কর্ম্মচারী। কালীবাবু যে গৃহে থাকেন, সেই স্ত্রীলোকটীও সেই গৃহে থাকে।

 আমি। তাহা হইলে কালীবাবু যে স্ত্রীলোকটীর গৃহে থাকেন, সেই স্ত্রীলোকটীই কালীবাবুর কথার পোষকতা করিতেছে?

 কর্ম্মচারী। হাঁ।

 আমি। রাণীজিও বোধ হয়, তিনিই হইয়াছিলেন?

 কর্ম্মচারী। হাঁ।

 আমি। সেই স্ত্রীলোকটীর নাম কি?

 কর্ম্মচারী। তাহার নাম ত্রৈলোক্য।

 আমি। বাড়ীর অপরাপর ভাড়াটিয়াগণ কি বলে?

 কর্ম্মচারী। তাহারা সবিশেষ কিছুই বলিতে পারে না। তাহারা কেবল এইমাত্র বলে যে, কাহার গৃহে কে আসিতেছে, কে যাইতেছে, তাহার খবর কে রাখে? বিশেষতঃ এরূপ সংবাদ রাখা তাহাদিগের নীতি-বিরুদ্ধ।

 আমি। পশ্চিমদেশীয় একটা লোক যে সেই বাড়ীতে কতকগুলি জহরত লইয়া গমন করিয়াছিল, তাহা কেহ বলে?

 কর্ম্মচারী। সবিশেষ কিছু বলিতে পারে না, তবে এইমাত্র বলে যে, কালীবাবুর সহিত সময় সময় বঙ্গদেশীয়, পশ্চিমদেশীয় প্রভৃতি অনেক লোক প্রায়ই তাঁহার গৃহে আসিয়া থাকে, এরূপ তাহারা দেখিতে পায়।

 আমি। কত টাকার জহরত খরিদ করা হয়?

 কর্ম্মচারী। কালীবাবু কহেন, দশ হাজার টাকায় সেই সকল জহরত খরিদ করা হইয়াছিল।

 আমি। টাকাগুলি কিরূপ অবস্থায় রামজীলালকে প্রদান করা হয়,—নগদ টাকা দেওয়া হয়, না নোট দেওয়া হয়?

 কর্ম্মচারী। সমস্তই নোট, নয়খানি হাজার টাকার হিসাবে নয় হাজার, এবং একশতখানি দশ টাকা হিসাবে এক হাজার টাকা।

 আমি। সেই হাজার টাকা হিসাবের নোটগুলির নম্বর পাইবার কোনরূপ উপায় আছে কি?

 কর্ম্মচারী। সমস্ত নম্বরই আমি পাইয়াছি।

 আমি। কিরূপে সেই সকল নোটের নম্বর পাইলেন?

 কর্ম্মচারী। কালীবাবুর নিকট হইতে। যে সময় নোটগুলি রামজীলালকে দেওয়া হয়, সেই সময় কালীবাবু সেই সকল নোটের নম্বর টুকিয়া রাখিয়াছিলেন। তিনি আমাকে সেই সকল নম্বর প্রদান করিয়াছেন।

 আমি। সেই নোটগুলি সম্বন্ধে করেন্‌সি আফিসে একবার অনুসন্ধান করা উচিত।

 কর্ম্মচারী। সে অনুসন্ধানও আমি করিয়াছি। সেই সকল নোটের টাকা দেওয়া স্থগিত (Stop) করিবার মানসে করেন্‌সি আফিসের বড় সাহেবের নামে একখানি পত্র লেখা হয়। সেই পত্রের জবাবে তিনি যাহা বলিয়াছেন, তাহাতেই রামজীলালের উপর আরও সবিশেষরূপ সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে।

 আমি। পত্রের উত্তরে তিনি কি লিখিয়াছেন?

 কর্ম্মচারী। তিনি লিখিয়াছেন যে, সমস্ত নোটগুলিই রামজীলাল নামক এক ব্যক্তি সেই স্থানে প্রদান করিয়া তাহার পরিবর্ত্তে দশ টাকার হিসাবে নোট বাহির করিয়া লইয়া গিয়াছে।

 আমি। এটী সবিশেষ সন্দেহের কথা!

 কর্ম্মচারী। এই সন্দেহের উপর নির্ভর করিয়া তাহার নামে ওয়ারেণ্ট বাহির করিয়াছি।

 আমি। সেই জমিদার-পুত্ত্রটী কে, তাহার কিছু অবগত হইতে পারিয়াছেন কি?

 কর্ম্মচারী। তাহা আমি এ পর্য্যন্ত কিছুই জানিতে পারি নাই। কালীবাবু কোনরূপেই তাঁহার নাম বলিতে সম্মত নহেন, বা তাঁহার বাড়ী দেখাইয়া দিতে বলায়, তিনি বলেন যে, কোথায় যে তাহার বাড়ী, তাহা তিনি অবগত নহেন। বাড়ীর ঠিকানা তিনি কখনও কাহারও নিকট প্রকাশ করেন নাই, নামও বলেন নাই; রাজাসাহেব বলিয়াই সকলে তাঁহাকে ডাকিয়া থাকেন।

 আমি। জহরত খরিদ করিবার পর, রাজাসাহেব ত্রৈলোক্যের গৃহে আর আগমন করিয়াছিলেন কি?

 কর্ম্মচারী। তাহার পর দুই একদিবস আসিয়াছিলেন মাত্র; কিন্ত আজ কয়েকদিবস পর্য্যন্ত আর তিনি সেই স্থানে আগমন করেন নাই।

 আমি। কেন আসেন নাই, সেই সম্বন্ধে কেহ কোন কথা বলিতে পারে না কি?

 কর্ম্মচারী। ত্রৈলোক্য ও কালীবাবু ইহাই বলেন যে, রাজাসাহেব শেষদিবস যখন সেই স্থানে আগমন করিয়াছিলেন, সেই সময় তিনি বলিয়া যান যে, কোন সবিশেষ কার্য্য উপলক্ষে তাঁহাকে তাঁহার দেশে গমন করিতে হইতেছে। বোধ হয়, সেই স্থানে তাহাকে মাসাবধি অবস্থান করিতে হইবে। সুতরাং এক মাসের মধ্যে তিনি আর এখানে আগমন করিবেন না।

 আমি। রামজীলাল সম্বন্ধে আপনি কি অনুসন্ধান করিয়াছেন?

 কর্ম্মচারী। সবিশেষ কোনরূপ অনুসন্ধান করিয়া উঠিতে পারি নাই। কেবল কলিকাতার ভিতর যে যে স্থানে তাঁহার দেশের লোক বা আত্মীয়-স্বজন আছে, কেবল তাহারই কোন কোন স্থানে রামজীলালের অনুসন্ধান করিয়াছি মাত্র; কিন্তু এখন পর্য্যন্ত সকল স্থানে গমন করিতে পারি নাই। আমার বোধ হয়, রামজীলাল কলিকাতায় নাই। কারণ, কোন দিক হইতে তাহার কোনরূপ সন্ধান পাওয়া যাইতেছে না। আমার বোধ হয়, সে কলিকাতা পরিত্যাগ করিয়া স্থানান্তরে প্রস্থান করিয়াছে।

 আমি। নিতান্ত অসম্ভব নহে; কিন্ত রামজীলাল তাহার মনিবের এতদূর বিশ্বাসপাত্র হইয়া এরূপ অবিশ্বাসের কার্য্য করিবে? যাহা হউক, এ বিষয় একবার উত্তমরূপে দেখা আবশ্যক। অর্থের লোভে সময় সময় মনুষ্যগণ যে কি না করিতে পারে, তাহা বলা সহজ নহে। “অর্থই যে অনর্থের মূল” তাহার আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই।

 কর্ম্মচারী। এখন এ সম্বন্ধে আমাকে আর কিছু করিতে হইবে কি?

 আমি। হইবে বৈকি?

 কর্ম্মচারী। কি?

 আমি। রামজীলালকে সবিশেষরূপে অনুসন্ধান করিয়া তাহাকে ধরিতে হইবে।

 কর্ম্মচারী। আর কিছু?

 আমি। সেই জমিদার-পুত্ত্র যে কে, অনুসন্ধান করিয়া তাহার ঠিকানা করিতে হইবে।

 কর্ম্মচারী। এই সকল বিষয়ের অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত আমি এখন প্রস্তুত হইতে পারি কি?

 আমি। এই সকল বিষয়ের অনুসন্ধানের নিমিত্ত আপনি এখন যেস্থানে ইচ্ছা সেই স্থানে গমন করিতে পারেন; কিন্তু আপনি বহির্গত হইয়া যাইবার পূর্ব্বে আর একটী কার্য্য আপনাকে করিতে হইবে।

 কর্ম্মচারী। কি?

 আমি। আমার সহিত কালীবাবুর বাড়ীতে একবার গমন করিয়া কালীবাবু ও ত্রৈলোক্যকে আমাকে দেখাইয়া দিতে হইবে।

কারণ, তাহারা যে কে, এবং কি চরিত্রের লোক, সেই সম্বন্ধে আমি সময় মত একবার উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিয়া দেখিব; এবং সেই বাড়ীর অপর ভাড়াটিয়াগণের মধ্যে যদি কেহ সেই জমিদার-পুত্ত্রের কোনরূপ সন্ধান করিয়া উঠিতে পারেন, তাহারও সবিশেষরূপ চেষ্টা করিয়া দেখিব।

 আমার কথায় কর্ম্মচারী মহাশয় সম্মত হইলেন। আমার অবকাশ মত তিনি আমার সহিত গমন করিয়া, কালীবাবু ও তাঁহার উপপত্নী ত্রৈলোক্যকে আমাকে দেখাইয়া দিবেন, ইহাই স্থিরীকৃত হইল।

 আমি অতিশয় ক্লান্ত ছিলাম; সুতরাং সেই দিবসেই আমি আর কালীবাবুর বাড়ীতে গমন করিতে পারিলাম না।