বিষয়বস্তুতে চলুন

মধুমল্লী/মা

উইকিসংকলন থেকে

মা

 মিসেস্ ম্যাকোহন এই একমাত্র সন্তানটিকে জন্ম দিয়া যখনই রোগশয্যা গ্রহণ করিলেন, তখন হইতে তাঁহার পিতৃস্নেহবঞ্চিত শিশুটির ভবিষ্যৎ চিন্তায় তাঁহার দুশ্চিন্তাপীড়িত ও ভবনার ঘনজালে আচ্ছন্ন হইয়া উঠিল।

 গুলজান শিশুর ধাত্রী। সে তাহার উকি-রঞ্জিত শ্যামল অনাবৃত বাহুর উপরে তাঁহার শুভ্র মল্লিকা ফুলের মত সুন্দর শিশুটিকে দোলাইয়া ঘুমপাড়ানি ছড়া বলিতে বলিতে সম্মুখের বারান্দায় পায়চারি করিয়া বেড়াইতেছিল।

 “না রাজা কা পলটন না রাজাকা ঘোড়া,—মুলুকমে বাবুয়াকা কোই নেই জোড়া। আগে যায় বোসনাইয়া, পিছে যায় হাতী, মেরি গদিপর চলে বাবু, মাথে লাল ছাতি।”

 মিসেস্ ম্যাকোহন জরতপ্ত ললাটে উত্তপ্ত হস্ত ঘর্ষণ করিয়া দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিলেন। কত সাধের ধন তাঁহার—তিনি তাহাকে একটি দিনের জন্যও অমনি করিয়া কোলে লইয়া আদর করিতে পারিলেন না। এ দুঃখ মরিলেও যাইবে না।

 শিশু ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল, গুলজান তাহাকে দোলার বিছানায় শোয়াইয়া সাবধানে নেটের ছোট মশারিটি টানিয়া দিয়া রোগীর গৃহে প্রবেশ করিল।

 মিসেস ম্যাকোহন তাঁহার বিবাহিত তিনটি বৎসর এই বিদেশী সঙ্গিনী গুলজানের সেবা, যত্ন ও আন্তরিক হৃদ্যতায় তাহার সহিত প্রভু-ভৃত্য সম্বন্ধ বিস্মৃত হইয়া তাহাকে যেন তাঁহার এ সংসারের একমাত্র সহায়রূপেই দেখিতেছিলেন। রোগ যতই বৃদ্ধির দিকে অগ্রসর হইতেছিল বিদায়ের কাল ততই নিকটতর হইতেছে। বুঝিতে পারিয়া স্বামীপ্রেমে বঞ্চিতা দুর্ভাগিনী তাঁহার হতভাগ্য সন্তানের জন্য ইহাকেই তত নির্ভর করিরা ধরিতেছিলেন। ছেলেটি যেন গুলজানের প্রাণ। তাহারই বয়সী তাহার নিজের ছেলে ইয়াসিনের চেয়েও সে যেন তাহাকেই অধিকতর ভালবাসে।

 গুলজান্ ভূমে বসিয়া তাহার উত্তপ্ত ললার্টে ধীরে ধীরে হাত বুলাইতে লাগিল; বিষন্ন চক্ষু তাঁহার জ্যোতিহীন উৎসুক নেত্রের সহিত মিলিত করিয়া কহিল “মেমসাহেব!”

 “প্রতিজ্ঞা করো গুলজান্ যে আমি ম’রে গেলে তুমি আমার যাদুকে, আমার জেসুনকে ছেড়ে যাবে না? যতদিন বেঁচে থাক‍্বে তাকে ইয়াসিনের মতন ভাল বাসবে?” দুর্ব্বল হস্ত গুলজানের স্থূল বাহুর উপরে স্থাপন করিয়া স্নেহ-কাতর জননী ধাত্রীর মুখের দিকে ব্যাকুলনেত্রে চাহিয়া এই কথা বললেন। যেন এই অনুরোধটি রক্ষিত হইলে তিনি যতটুকু সম্ভব শান্তভাবে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হইবার চেষ্টা করিতে পারেন। গুলজান্ তাহার ‘ছোট বাবা’কে তাহার ইয়াসিনের মত ভালবাসা দিতে হৃদয়ের সঙ্গেই প্রস্তুত আছে, তাহার জন্য তাহাকে আর নূতন করিয়া চেষ্টা করিতে হইবে না! কিছু না ভাবিয়া না চিন্তিয়া কাতর চিত্তে দৃঢ়কণ্ঠে গুলজান্ বলি গেল, “আল্লার নামে শপথ, আমার প্রাণ থাক‍্তে আমি আপনার ছেলেকে ছেড়ে যাব না। নিজের ছেলের চেয়েও বেশী যত্নে তাকে পালন কর‍্ব।”

 মিসেস ম্যাকোহনের নেত্রজ্যোতি প্রদীপের শেষ রশ্মিটুকুর মত পরম উজ্জ্বল হইয়া উঠিল।

 মেম সাহেবের মৃত্যুরপর কাপ্তেন সাহেব গুলজানকে ডাকাইয়া বলিলেন “তুমি ছেলেটাকে বড়ই ভালবাসো দেখতে পাই, তা ওটাকে আমি তোমাকেই দিলাম। আজ থেকে দশ টাকা ক’রে তুমি বেশি পাবে, ওর সব ভার তোমার। ওর সম্বন্ধে তুমি আমায় কোন রকম বিরক্ত করো না—ও কি! কেঁদে যে অস্থির হ’লে! যাও যাও, আমি কান্নাকাটি দেখতে পারিনে —যাও”।

 কে জানে কেন ছেলেটার জন্মদিন হইতেই কাপ্তেন সাহেবের তাহার প্রতি কেমন একটা অহেতুকী বিদ্বেষ জন্মিয়াছিল। একটা রাস্তার কুড়নো ছেলের উপর লোকের যেটুকু মায়া জন্মায় নিজের সন্তানের উপর সেটুকুও মমতা ছিল না। পত্নীর প্রতি ভালবাসার অভাবই বোধ হয় এ ভাবের মূলগত কারণ।

 গুলজান্ বেতন বৃদ্ধির জন্য আহ্লাদ প্রকাশ করিল না। তাহার বাছাকে সে যে নিজের কাছে পাইয়াছে, ইহাই তাহার যথেষ্ট পুরস্কার।

 বৎসর ঘুরিয়া গেল। জেসুন ও ইয়াসিন্ দুইটি বিভিন্ন জাতীয় শিশু একখানি স্নেহতপ্ত অঙ্ক জুড়িয়া এক ঙ্গেই বাড়িয়া উঠিতে লাগিল। একটি সরল শাখা দুইটি কোমল লতাকে যেমন স্নেহে বক্ষে ধরিয়া থাকে, গুলজানের চিত্তও সেইরূপ তাহার দেহসম্ভূত ও প্রতিপালিত শিশু দুটির মধ্যে কোন প্রকার পার্থক্য বোধ করিত না।

 মেজর লরির স্ত্রীর সহিত ছেলে দুটিকে লইয়া গুলজানকে কাপ্তেন সাহেব পাহাড়ে পাঠাইলেন।

 পাহাড় হইতে ফিরিবার দিন মিসেস লরি তাহাকে তাহার নৃতন প্রভু-পত্নীর সংবাদ জানাইয়া কহিলেন, “কাপ্তেন সাহেব তোমায় পূর্ব্বে জানাতে নিষেধ করে ছিলেন তাই এতদিন বলিনি।”

 গুলজানের বর্ণ সাধারণ নিম্নশ্রেণীর ভারতীয় স্ত্রীলোকের মত কালো ছিল না। তাহার শ্যামবর্ণ মুখ সহসা পাংশু হইয়া গেল, গৃহে বিমাতা আসিয়াছে! যদি সে বাছাকে তাহার কোল হইতে ছিনাইয়া লয়?

 ট্রেণ হতে নামিবার সময় তাহার পা কাঁপিতেছিল, শিশুকে সে দৃঢ় হস্তে চাপিয়া ধরিয়া অনিচ্ছুক ভাবেই নামিল।

 ষ্টেশনে প্রভু বা প্রভুপত্নীর সহিত তাহাদের সাক্ষাৎ হইল না, বাড়ী আসিয়া পৌঁছিলে বারান্দায় সে কাপ্তেন সাহেবের সহিত তাঁহার নূতন স্ত্রীকে দেখিল। নূতন গৃহিণী সুন্দরী ও সুস্বাস্থ্যসম্পন্না। প্রথম দর্শনেই তাঁহার বেশভূষা ও ধরণধারণে গুলজানের চিত্ত তাহার প্রতি বিদ্রোহী হইয়া উঠিল। হায়! তাহার মেম সাহেব সেই নম্রশান্তকরুণহৃদয়া নারী, তিনি কখনও এমন দামী পোষাক এমন উজ্জ্বল হীরার আংটি পরিতে পান নাই। নৃতন মিসেস ম্যাকোহন ঈষৎ হাসিয়া শিশুর দিকে হাত বাড়াইয়া দিলেন। গুলজানের বুকটা অমনি একটা অনিশ্চিত আশঙ্কায় কাঁপিয়া উঠিল! শিশু কিন্তু বিমাতার কোলে গেল না, সে দুই হাতে ধাত্রীর কুত্তাটা চাপিয়া ধরিল। কাপ্তেন সাহেব স্ত্রীর হাত ধরিয়া বললেন,—

 “কোনও দরকার নেই ক্লেরা! ওটাকে আমি আয়ার হাতে দিয়েছি। ছেলের হাঙ্গাম তোমায় বইতে হবে না, চলো আমরা বেড়িয়ে আসি।”

 তাহার বুকের দুলালকে পাছে কাড়িয়া লয় এই ভয়ে গুলজানের নিশ্বাস যেন রুদ্ধ হইয়া আসিতেছিল—মনিবের কথা শুনিয়া হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিল। শিশুকে সে চুম্বনের পর চুম্বন করিয়া বিব্রত করিয়া তুলিল।

 কিন্তু এ আনন্দ স্থায়ী হইল না। গুলজান শীঘ্রই বুঝিতে পারিল পদ্মপত্রে জলবিন্দুর মত তাহার অধিকার এখানে প্রতি মুহূর্ত্তেই অস্থায়ী হইয়া উঠিতেছে। নূতন গৃহিণী তাহাকে দেখিতে পারেন না।

 সপত্নীসন্তান সাধারণতঃ বিমাতার স্নেহভাজন হইতে পারে না। বিশের্ষ আবার যেখানে স্বয়ং শিশুর পিতাই তাহার প্রতি স্নেহলেশহীন! জেসুন্ তাহার সৌখীন বিমাতার চক্ষুশূল হইতেছিল।

 একদিন গুলজান্ নিজের ঘর হইতে উচ্চ ক্রন্দনের শব্দ পাইয়া ঊর্দ্ধশ্বাসে ছুটিয়া আসিয়া দেখিল, মিসেস্ ম্যাকোহন তাঁহার মেহগ্নি ব্রূস দিয়া শিশুকে প্রহার করিতেছেন। ক্রোধে তাহার আপাদমস্তক জ্বলিয়া উঠিল। জ্ঞানশূন্য হইয়া সে প্রভুপত্নীর হস্ত হইতে ব্রূসখানি টানিয়া লইয়া সবেগে দূরে ছুড়িয়া ফেলিয়া তীব্র ভর্ৎসনা সূচক স্বরে উচ্চারণ করিল—“মেম সাহেব!”

 তারপর আহতপৃষ্ঠ রোদনকম্পিত শিশুকে কোলে উঠাইয়া লইয়া দ্রুতপদে সে ঘর হইতে চলিয়া যাইতে উদ্যত হইল। মিসেস্ ম্যাকোহন গম্ভীর স্বরে কহিলেন “পাজি ছেলেটাকে তুমি যে রকম নষ্ট ক’র‍্চ তাতে শীঘ্রই সে ডাকাতের দলে ঢুকবে দেখচি। আর না!—আমাকে শোধরাবার ব্যবস্থা ক’রতে হবে।”

 গুলজান্ সব কথা দাঁড়াইয়! না শুনিয়াই চলিয়া গেল, কিন্তু পরক্ষণেই তাহার মনের ভিতরে নিজের ব্যবহারের ফল, আসন্ন বিপদের একটা ছায়া উজ্জ্বল হইয়া ফুটিয়া উঠিল! শিশুকে পুরাতন ভৃত্য ফৈদুর কাছে রাখিয়া একটু মিছরি হাতে দিয়া সে সশঙ্কচিত্তে প্রভুপত্নীর গৃহে ফিরিয়া আসিয়া চোখের জলে ভাসিয়া বলিল, “মেম সাহেব! নিজের ব্যবহারের জন্য আমি নিতান্ত দুঃখিত হচ্চি, দয়া ক’রে এবারকার মত আমায় মাপ করুন, আর কখনও আমি এ রকম ক’রবো না। ছেলেটা আমার প্রাণ, তাই হঠাৎ বড় রাগ হয়ে গেছলো! আমরা মুখ্য ছোট লোক, আমাদের কথা কি ধরতে হয়?”

 মিসেস্ ম্যাকোহন হিন্দি ভাষা ভাল বুঝতেন না, তথাপি যেটুকু বুঝলেন তাহাতে তাঁহার সংকল্প শিথিল হইল না। স্থির কণ্ঠে কহিলেন “তোমার মাহিনা বুঝিয়ে দেওয়া হচ্চে, তুমি এখনি যাও, ছেলে তোমার নয়, আমি ওকে আজ থেকে সোজা করবার ব্যবস্থা ক’রচি।”

 গুলজান্ মুহূর্ত্তে চারিদিক অন্ধকার দেখিল। আর্ত্তভাবে সে প্রভুপত্নীর পদতলে বসিয়া দুই হাত যুক্ত করিয়া কাঁদিয়া কহিল “মেম সাহেব! আমায় তাড়িয়ে দিবেন না। মৃত মেম সাহেবের কাছে আমি সত্য করেছি কখনও তাঁর ছেলেকে ছেড়ে যাব না। হয় দয়া করে আমাকে রাখুন, না হয় আমার বাচ্চাকে আমার সঙ্গে নিয়ে যেতে দিন।”

 “এ মাগীর তো স্পর্ধাও কম না!” ঘৃণার সহিত গৃহিণী হাসিয়া ফেলিলেন। কাপ্তেন সাহেব গুলজানের সজল গম্ভীর কণ্ঠ শুনিয়া গৃহের মধ্যে উকি দিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন ‘ব্যাপার কি ক্লেরা?”

 ক্লেরা কহিল “আমি ওকে মাইনে চুকিয়ে দিয়ে চলে যেতে বলচি, কিন্তু উনি কিছুতেই যাবেন না।”

 কাপ্তেন সাহেব ভ্রূভঙ্গী করিয়া দ্বারের উপরে মুষ্ট্যাঘাত ও ভূমে পদাঘাত করিয়া কহিয়া উঠিলেন “তুমি যখন যেতে বলছো তখন নিশ্চয়ই ওকে এক্ষণি যেতে হবে, যাবে না কি!”

  মুহূর্ত্তে গুলজানের অশ্রু শুকাইয়া গিয়া দুই চক্ষু আগুনের মত প্রদীপ্ত হইয়া উঠিল, সে তৎক্ষণাৎ উঠিয়া দাঁড়াইয়া স্থির কণ্ঠে কহিল,—

 “হাঁ সাহেব, আমি যাচ্ছি!” তার পর সে দৃঢ় পদক্ষেপে ঘর ছাড়িয়া চলিয়া গেল।

 শিশু তখনও অনুচ্চ স্বরে কাঁদিতেছিল, পৃষ্ঠের কোমল চামড়া রাঙা হইয়া বহিয়াছে, মিছরি সে স্পর্শও করে নাই! ফৈদু শিশুকে প্রত্যার্পণ করিবার সময় ধাত্রীর মুখের অস্বাভাবিক গাম্ভীর্য্য দেখিয়া বিস্ময়ের সহিত চাহিয়া রহিল।

 কাপ্তেন সাহেব অল্পক্ষণ পরেই তাঁহার নূতন সঙ্গিনীর সহিত ক্লাবে চলিয়া গেলেন। চার ঘণ্টার পূর্ব্বে তাঁহারা ঘরে ফিরবেন না। গুলজান মনিবপুত্রকে কোলে তুলিয়া লইয়া নিজের ঘরে আসিল। একবার সে শিশুকে ভূমে নামাইয়া নিজের ছোট সিন্ধুকটি খুলিয়া তাহার সঞ্চিত টাকা পয়সাগুলি দড়ির গেঁজের মধ্যে পূরিয়া কোমরের ঘুন্সিতে বাঁধিয়া লইল, তারপর দুটি শিশুকে দুই কোলে লইয়া ধীর পদক্ষেপে গৃহ হইতে বাহির হইয়া গেল। উর্দ্ধে চাহিয়া মনে মনে কহিল “মেম সাহেব! তোমার কাছে প্রতিজ্ঞা করেছি—সেই সত্য রাখার জন্য আজ গুলজান এই পাপ করতে বাধ্য হলো। তুমি স্বর্গে থেকে সাহায্য কর। আমি বেঁচে থাকতে তোমার ছেলেকে নিষ্ঠুর বিমাতার হাতে দিতে পারবো না।”

 শিশুর সহিত গুলজানের অদৃশ্য হওয়ার সংবাদ প্রচার হইলে কাপ্তেন সাহেব কোন রকম চাঞ্চল্য প্রকাশ না করিয়াই স্ত্রীকে কহিলেন “আঃ যেতে দাও না ক্লেরা, কি হবে সেটাকে নিয়ে? তোমার আমার চেয়ে সে স্ত্রীলোকটা বরং ছেলেটাকে পেয়ে ঢের বেশি খুসী থাকবে।”

 কথাটা সত্য। তথাপি লোকে কি বলবে? এই বলিয়া মিসেস্ ম্যাকোহনের বিবেক এই নিষ্ঠুর যুক্তির বিপক্ষে জাগরিত হইয়া উঠিল।

 একটা আয়া দুই কাঁধে দুইটা সমবয়স্ক। শিশু—তাহার একটি সাদা ইউরোপীয় এবং অপরটি পশ্চিমী মুসলমান শিশু—লইয়া পলাতক, ইহাদের ধরিয়া দিতে পারিলে পুরস্কার দেওয়া হইবে, এইরূপ একটা বিজ্ঞাপন কাগজে দেওয়া হইল। কিন্তু চেষ্টা সফল হইল না। গৌরবর্ণ, শ্যামবর্ণ এবং কৃষ্ণবর্ণ একটি দুটি তিনটি ছেলে কোলে কাঁখে করা স্ত্রীলোক পথে ঘাটে অনেক দেখা গেল। শুভ্র শিশু সংযুক্ত নারী কোথাও মিলিল না।

 গুলজান্ গোরখপুর হইতে পলাইয়া হাঁটা পথে পশ্চিমবঙ্গ উত্তীর্ণ হইয়া পদ্মাপারে নিজের দূর সম্পর্কীয় ভ্রাতার কাছে আশ্রয় লওয়ার পর ষোল বৎসর অতীত হইয়া গিয়াছে। ইয়াসিন এখন সুশ্রী, সবল যুবাপুরুষ। এখন সে মাতুলের গাড়িঘোড়ার ব্যবসায়ের অংশীদার। গুলজান তাহার জন্য কঠিনতর পরিশ্রম করিতে এখনও শ্রান্তি বোধ করিত না। সে মায়ের চেয়ে দাসীর মতই তাহার সেবা করিত। ছেলেও মা ভিন্ন কাহাকেও চিনে না, এখন সে মায়ের কোলের শিশু, আদরের দুলাল!

 শরীরের শক্তিতে মনের তেজে ইয়াসিন নিজের কার্য্যে বেশ একটু উন্নতি করিতে লাগিল। তাহার মধ্যে কি ছিল তাহা নিজেই জানিত না, কিন্তু এইটুকু সে লক্ষ্য করিয়াছে যে, তাঁহার মুখ চাহিয়া দেখিলেই তাহার ইংরাজ আরোহীর চোখে একটা বিস্ময়পূর্ণ স্নেহ-করুণার ভাব ব্যক্ত হইয়া উঠিত এবং সে ভাড়াটা বেশ ভাল রকমই লাভ করিয়া আসিত। আর ইহাও এক বিচিত্র ব্যাপার যে, ঐ সকল সুপরিচ্ছদধারী সুন্দরমূর্ত্তি নরনারীদের দেখিলে তাহারও প্রাণের মধ্যে কি যেন একটা আকুলতা উদ্দাম হইয়া উঠিতে চাহিত; তাহাদের সান্নিধ্য সে চুম্বক পাথরের আকর্ষণের মত কিছুতেই যেন ছড়াইয়া লইতে পারত না।

 একদিন গুলজান্ দেখিল, ইয়াসিন্ নিজের অঙ্গ হইতে দড়ি বাঁধা মিরজাই খুলিয়া রাখিয়া বিস্ময় ব্যাকুলনেত্রে নিজের অঙ্গের প্রতি চাহিয়া আছে। গুলজানকে দেখিয়া সে ইঙ্গিতে কাছে আসিতে বলিল, কম্পিতপদে গুলজান্ নিকটে আসিলে, সহসা যুবক জিজ্ঞাসা করিয়া উঠিল “মা এর মানে কি আমায় ব’লো, কেন আমার গা এত সাদা? আমি শুনেছি—আজই শুনেছি—লোকে বলে—ওঃ আমি বলতে পারিনে—সে কি ভয়ানক কথা; —বলে আমি তোমার জারজ সন্তান। আমি সাহেবের ছেলে।”

 সর্পাহতের মত গুলজান আড়ষ্ট হইয়া রহিল, তাহার মুখে বাক্য সরিল না। সুদীর্ঘ দিনে যে স্মৃতি অস্পষ্ট হইয়া আসিয়াছিল, সহসা তাহা মেঘোদ্ভিন্ন সূর্য্যকিরণের মত ফুটিয়া উঠিল। নিষ্ঠুর সন্দেহে ইয়াসিন্ উন্মাদের মত লাফাইয়া মায়ের হাত চাপিয়া ধরিল।

 “সত্যি, তবে সত্যি! আমি তবে সাহেবের ছেলে?”

 যন্ত্র চালিতের মত গুলজান উত্তর করিল “হ্যাঁ”।

 “রাক্ষসি!” ইয়াসিন্ বাঘের মত গর্জ্জিয়া উঠিল “কেন আমায় নুন খাইয়ে মারিসনি?”

 গুলজানের সর্ব্বশরীর কাঁপিতেছিল। আত্মপরিচয় জানিয়া লইয়াছে, এইখান হইতেই সে তবে নিজের জন্য পথ নির্ব্বাচন করিয়া লউক। সে যে কোন্ পথ বাছিয় লইবে, ইহাও সে জানিত। কম্পিতস্বরে কহিল “বাছা, আমার সব কথা না শুনে তুমি রাগ করো না, আগে সবটা স্থির হয়ে শুনে যাও”—এই বলিয়া সে সমস্ত কাহিনীটা এক নিশ্বাসে বলিয়া গেল। সে বলিল “তুমি সাহেবের ছেলে এ কথা সত্য, কিন্তু আমার গর্ভে তোমার জন্ম হয়নি। আমার গর্ভজাত সন্তান ইয়াসিনের ষোল বৎসর পূর্ব্বে মৃত্যু হয়েছে; তুমি মেম সাহেবের পুত্ত্র। তোমার বাপ তোমার মাকে দুচক্ষে দেখ্‌তে পারতেন না, তোমার প্রতিও তাঁর এতটুকু স্নেহ ছিল না, তোমার মা মৃত্যুর ঠিক পূর্ব্বক্ষণেই আমাকে সত্য করিয়ে নিয়েছিলেন যে, জীবন থাকতে আমি তোমায় ছেড়ে যাব না।”

 তারপর সে অত্যন্ত মৃদু ও হৃদয়ভেদী স্বরে তাহাদের পলায়নের কাহিনী বিবৃত করিতে লাগিল, শুনিয়া ইয়াসিন্ কিছুই বলিল না। সে যেন অকস্মাৎ একটা প্রস্তর মূর্ত্তিতে পরিণত হইয়া গিয়াছিল।

 গুলজান্ কহিতে লাগিল—“শুনলুম আমাদের ধরবার জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। ধরা পড়লে যে কি হবে আমার জানাই ছিল, মাথায় বজ্রাঘাত পড়ল। গোরখপুরের শালের জঙ্গলে একজন সন্ন্যাসী থাকতেন, তাঁহারই কাছে গিয়ে কেঁদে পড়লুম। তিনি বল্লেন,—দুজন সঙ্গে থাকলে ধরা পড়বে, একজনকে ত্যাগ করে যাও। পরামর্শ উচিত মতই, কিন্তু করা বড় কঠিন। কাকে ত্যাগ করব? কোথায় রাখব? বিশ্বাস করবার কে আছে যে পুরস্কারের লোভে আমাদের ধরিয়ে দেবে না? আমি তোমার মাকে স্মরণ করলুম। বল্লুম—“আমার সমস্যা দূর করে দাও, নিজের ছেলের মায়ায় আমি যেন তোমার ছেলেকে ফেলে না যাই। তার বিমাতা বড়ই নিষ্ঠুর!” বোধ হয় তোমার মা সে কথা স্বর্গে থেকে শুনেও ছিলেন। সেই রাত্রেই ফকিরের আশ্রমে আমার নিজের ছেলেকে ফেলে তোমাকে তার কাপড় পরিয়ে ও এক রকম রং মাখিয়ে নিয়ে আবার পথে বার হলুম। ইয়াসিনের ক্ষীণ ক্রন্দন ক্রোশের পর ক্রোশ ধরে আমার কানে বাজতে লাগল, জ্বরে সে যেন সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিল। কিন্তু সত্য যে সবার চেয়ে বড়! ঈশ্বর যে সকলেরই উপরে বাপ! আমি যে তোমার মাকে কথা দিয়েছিলুম! এখানে আসবার পর চিঠি লিখে খপর নিয়েছিলুম, সেই রাত্রেই সে মারা গ্যাছে। আমি মনে করি তুমিই আমার ইয়াসিন্।

 এখন তুমি বড় হ’য়েছ, তোমার পথ তুমি ঠিক করে নাও,—তবে আমার প্রতি এইটুকু দয়া করো, যেখানে থাকো আমাকে তোমার বাড়ির দাসী করে রেখো।”

 ইয়াসিন্ অনেকক্ষণ নিস্পন্দ হইয়া শূন্যদৃষ্টিতে একদিকে চাহিয়া রহিল। তারপর হঠাৎ সে স্বপ্নমুগ্ধের মত এক পা এক পা করিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। একটিও কথা কহিল না। গুলজান্‌ও তাহাতে তাহাকে বাধা দিল না। নিজে সে নিঃশব্দে কাঁদিতেছিল।

 সমস্ত দিন পথে পথে ঘুরিয়া রাত্রে আবার ইয়াসিন্ গৃহে ফিরিয়া আসিল। গুলজান্ও জানিত যে, সে আর একবার আসিবে। সে তাহার প্রতীক্ষা করিতেছিল। ইংরাজটোলায় আজ ইয়াসিন্ অনেক ঘণ্টা কাটাইয়াছে। খোলা জানালার নেটের পর্দ্দা বাতাসে কাঁপিয়া সরিয়া যাইতেছিল; ভিতরে শুভ্র আস্তরণবিস্তৃত টেবিল ঘেরিয়া চৌকিগুলি সাজান, হাস্যকৌতুকোচ্ছ্বসিত সুপরিচ্ছদধারীগণ সেই চৌকি দখল করিয়া রহিয়াছে। রৌপ্য চামচের টুন্ টান্ শব্দে এবং খাদ্য ও পানীয় দ্রব্যের সুপ্রচুর সদ্‌গন্ধে বায়ু পূর্ণ করিয়া মধ্যাহ্নভোজন চলিতেছে। সন্ধ্যায় কোন গৃহে মধুরস্বরে পিয়ানো বাজিয়া উঠিল, কোনও উদ্যানপথে শ্রান্ত প্রণয়ী দুইখানি ব্যগ্রহস্তে বাঁধা পড়িলেন। কোথাও বা ঠেলা গাড়িতে শিশুকে বসাইয়া পার্শ্বে জনকজননী স্নেহহাস্যে তাহার দিকে চাহিয়া আছেন। ইয়াসিনের প্রাণের ভিতরে ব্যাকুলতা অসম্বরণীয় হইয়া উঠতে লাগিল। সে এই দীনহীন অশ্বপালক—ছিটের মেরজাই গায়ে নাগারা-জুতা-পরা নগণ্য ঘৃণিত ইয়াসিন্; সে কিন্তু উহাদেরই মত ইংরেজসন্তান, ইহারা তাহার আপনার লোক! সেও এইরূপ সুখস্বাচ্ছন্দ্য এই মূহুর্ত্ত হইতেই ক্রয় করিতে সক্ষম। শুধু এক বার ছুটিয়া গিয়া ওই যে—ম্যাজিষ্ট্রেট, জেলার আদালত হইতে শতপ্রাণীর মুণ্ডদণ্ডের ব্যবস্থা করিয়া টম্‌টম চড়িয়া ফিরিতেছেন, তাঁহাকে সব কথা বলিবার মাত্র অপেক্ষা।

 কিন্তু— না না একি সে ভাবিতেছে! সে পাগল হইয়া যাইবে না কি? সে তো গুলজানের কথা ভাবিতেছে না? ম্যাজিষ্ট্রেট যখন তাহার কাহিনীর সত্যাসত্য বিচার করিবার জন্য তাহাকে ডাকাইয়া আনিবেন? এবং তারপর, পরের ছেলে—ইংরাজের সন্তানকে তাহার পিতৃগৃহ হইতে চুরি করিয়া আনার জন্য তাহাকে যখন চালান দিবেন? উঃ না! ঈশ্বর তাহাকে এই দুরন্ত লোভ হইতে রক্ষা করুন।

 গভীর অন্ধকারে চারিদিক ভরিয়া গিয়াছিল। দরিদ্র পল্লীতে কচিৎ কোন ক্ষুদ্র জানালার ভগ্ন কবাটের ফাঁক দিয়া কেরোসিনের প্রচুর ধূমের সহিত ক্ষীণালোকরেখা প্রকাশিত হইতেছে। ইহার ভিতরে সমস্ত নিস্তব্ধ হইয়া গিয়াছে। তীব্রস্বরে ঝিঁ ঝিঁ ডাকিতেছিল। অস্ফুট নক্ষত্রালোকে গুলজান্ দাওয়ায় চারপায়ার উপরে চুপ করিয়া বসিয়া আছে। ইয়াসিন্ আসিয়া কাছে দাঁড়াইল। সে বেশ করিয়া ভাবিয়া দেখিয়াছে, গুলজান কে ফাঁসাইয়া সে নিজেকে কাপ্তেন ম্যাকোহনের পুত্ত্র বলিয়া প্রমাণ করিতে পারিবে না— কিছুতেই না! পথে দুইজন ইংরাজের সহিত তাহার সাক্ষাৎ হইয়াছিল। তাহারা চলিতে চলিতে হঠাৎ তাহার দিকে চাহিয়া থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িয়াছিল। সেও কৌতুহলী হইয়া চলিয়া না গিয়া দাঁড়াইয়া দুই চোখ তুলিয়া তাহাদের চোখের দিকে চাহিয়া দেখিল। একজন ইংরাজ অপরকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, “বাই জোভ! নিশ্চই এ ছেলেটি একজন ছদ্মবেশী ইউরোপিয়ান্!” বাঘের মত গর্জ্জিয়া উঠিয়া সে তাহাদের উপর লাফাইয়া পড়িল, গর্জ্জন স্বরে কহিয়া উঠিল “চুপ রও!”

 ইংরাজ দুজন উচ্চহাস্য করিয়া চলিয়া গেল।

 অন্ধকারে কেহ কাহারও মুখ দেখিতে পাইতেছিল না। রাত্রের বাতাস কেবলি বিলাপের নিঃশ্বাসের মত ঘরে ও বাহিরে ঘুরিয়া ফিরিতেছিল। দু একটা নিশাচর প্রাণীর ক্ষীণ কণ্ঠশব্দ আর্ত্তহৃদয়ের যন্ত্রণাধ্বনির মত শূন্যে চকিত হইয়া মিলাইয়া যাইতেছে। মৃদুস্বরে গুলজান্ ডাকিল—“ইয়াসিন্!—জেসুন বাবা!”

 জেসুন তাহার কর উপর মাথা রাখিয়া বলিল—“মা!”