ভানুসিংহের পত্রাবলী/৩৯
৩৯
শিলং
আমি যেদিন এখানে এসে পৌঁচলুম সেদিন থেকেই বৃষ্টি-বাদলা কেটে গিয়েচে। আজ এই সকালে উজ্জ্বল রৌদ্রালোকে চারিদিক প্রসন্ন; মোটা মোটা গোটাকতক মেঘ পাহাড়ের গা আঁক্ড়ে ধ’রে চুপ্চাপ রোদ পোয়াচ্চে; তাদের এম্নি বেজায় কুঁড়ে রকমের চেহারা-যে, শীঘ্র তা’রা বৃষ্টি বর্ষণে লাগবে এমন মনেই হয় না।
আমার এখানকার লেখ্বার ঘরের সঙ্গে শান্তিনিকেতনের সেই কোণটার কোনো তুলনাই হয় না। বেশ বড়ো ঘর—নানা রকমের চৌকি, টেবিল, সোফা, আরামকেদারায় আকীর্ণ। জান্লাগুলো সমস্তই শার্সির, তার ভিতর থেকে দেখ্তে পাচ্চি, দেওদার গাছগুলো লম্বা হ’য়ে দাঁড়িয়ে উঠে বাতাসে মাথা নেড়ে নেড়ে আকাশের মেঘের সঙ্গে ইসারায় কথা বল্বার চেষ্টা ক’র্চে। বাগানের ফুলগাছের চান্কায় কত রঙবেরঙের ফুল-যে ফুটেচে তা’র ঠিক নেই,—কত চামেলি কত চন্দ্রমল্লিকা, কত গোলাপ,—আরো কত অজ্ঞাতকুলশীল ফুল। আমি ভোরে সূর্য্য ওঠ্বার আগেই রাস্তার দুইধারের সেই সব ফোটা ফুলের মাঝখান দিয়ে পায়চারি ক’রে বেড়াই—তা’রা আমার পাকা দাড়ি আর লম্বা জোব্বা দেখে একটুও ভয় পায় না—হাসাহাসি করে।
এই পর্য্যন্ত লিখেচি, এমন সময়ে সাধু এসে খবর দিলে, স্নানের জল তৈরি। অম্নি কলম রেখে চৌকি ছেড়ে রবিঠাকুর দ্রুতপদবিক্ষেপে স্নানযাত্রায় গমন ক’র্লেন। স্নান ক’রে বেরিয়ে এসে খবর পাওয়া গেল—কী খবর বলো দেখি? আন্দাজ ক’রে দেখো। খবর পাওয়া গেল-যে, রবিঠাকুরের ভোগ প্রস্তুত—শ্রীযুক্ত তুলসী নামক উৎকলবাসী পাচকের স্বহস্তে পাক-করা। আহার সমাধা ক’রে এই আস্চি—সুতরাং চিঠির ওভাগে পূর্ব্বাহ্ণ ছিল, এ ভাগে অপরাহ্ণ প’ড়েচে-এখন ঘড়ির কাঁটা বেলা একটার দিকে অঙ্গুলি নির্দ্দেশ ক’র্চে। সেই মোটা মেঘগুলো শাদাকালো রঙের কাবুলি বেড়ালের মতো এখনো অলসভাবে স্তব্ধ হ’য়ে রোদ্রে পিঠ লাগিয়ে প’ড়ে আছে। পাখী ডাক্চে আর জানালার ভিতর দিয়ে চামেলি ফুলের গন্ধ আস্চে।
ঐ মেঘগুলোর দৃষ্টান্ত অনুসরণ ক’রে একটা লম্বা কেদারা আশ্রয় ক’রে নিস্তব্ধভাবে জানালার কাছে যদি ব’স্তে পার্তুম তা হ’লে সুখী হতুম কিন্তু অনেক চিঠি লিখ্তে বাকি আছে। অতএব গিরি-শিখরে এই শরতের অপরাহ্ণ আমার চিঠি লিখেই কাট্বে। তুমি ছবি আঁক্চো কি না লিখো; আর সেই এস্রাজের উপর তোমার ছড়ি চ’ল্বে কিনা তাও জান্তে চাই। ইতি ২৮শে আশ্বিন, ১৩২৬ (তারিখ ভুল করিনি—পাঁজি দেখে লিখেচি)।