ষষ্ঠীতৎপুরুষনামা/২৮
২৮
চিফ কমিশনার শাসিত আসাম পুনর্গঠিত হল গভর্নর শাসিত রাজ্য হিসেবে এতাবৎ চিফ কমিশনারদের লাটসাহেবও বলা হত। আর্চডেইল আর্লের পরবর্তী লাটসাহেব বিটসন বেলই আসামের প্রথম গভর্নরের দায়িত্ব পেলেন। ইতিমধ্যে তিনি অবশ্য চিফ কমিশনার হিসেবে কার্যকালে আসামে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। এই গভর্নর শাসিত প্রদেশের ‘আইন পরিষদে’ সুরমা উপত্যকা থেকে ১৬ জন সদস্যের মধ্যে সরকার মনোনীত সদস্য হিসেবে রায়বাহাদুর বিপিনচন্দ্রও একটি স্থান লাভ করলেন। তিনি যখন এই রিফর্মড কাউন্সিল বা আইন পরিষদের অধিবেশনে, অনুজ স্বদেশি ভ্রাতা যতীন্দ্র তখন ব্রিটিশ কারাগারে বন্দি। সুরমা এবং আসাম উপত্যকার কংগ্রেস নেতৃত্বের প্রবল বিরোধিতা এবং প্রতিরোধের মধ্যেই অধিবেশন শুরু হল। ভূ-স্বত্ব এবং প্রজাস্বত্ব আইনের প্রস্তাব কোন মতেই পাশ করানো গেল না। কিন্তু জনমত উপেক্ষা করেই প্রিন্স অব ওয়েলসের আগমনকে স্বাগত জানানোর প্রস্তাব পাশ হয়ে গেল। লোক্যাল বোর্ড বিষয়ক একটি প্রস্তাবে অভিমত দিলেন বিপিনচন্দ্র। তা ছাড়াও রাজ্যে একস্ট্রা অ্যাসিস্টেণ্ট কমিশনার, সাবডেপুটি পদ পুরণের উপরও জোরালো বক্তব্য রাখলেন। গোচারণ ভূমিকে করমুক্ত করা, আফিম সেবনকে নিয়ন্ত্রণে আনা, প্রাথমিক শিক্ষা সম্প্রসারণ এবং সর্বোপরি মহিলাদের ভোটাধিকার বিষয়ক প্রস্তাব নিয়ে আলোচনায় বিপিনচন্দ্র বিশেষ ভূমিকা নিলেন। সদনে উপস্থিত সিলেটের কৃষ্ণসুন্দর দাম, আসাম উপত্যকার নীলমণি ফুকনের মতো কংগ্রেসি নেতারা। সুনামগঞ্জের ব্রজেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী আর কাছাড়ের খান সাহেব রাশিদ আলি লস্করের সঙ্গে বিপিনচন্দ্রের সখ্য এত ঘনিষ্টতার দিকে গেল যে তিনি নির্ধারিত সরকারি আসন ছেড়ে এদের সঙ্গে এক সারিতেই বসে গেলে এ নিয়ে বিস্তর হাসি ঠাট্টা মস্করাও হয়ে গেল।
ওদিকে পরিষদের বাইরে আসামের রাজনৈতিক পরিস্থিতে একটা নতুন ব্যাপার ঘটতে থাকে। পরিষদীয় রাজনীতির অংশীদার হতে অস্বীকার করে যাঁরা বাইরে রয়েছেন এরা ভিড়েছেন চিত্তরঞ্জন দাশের ‘স্বরাজ্য দলে।’ গান্ধির সঙ্গে কয়েকটি বিষয়ে মতানৈক্য হওয়ায় তরুণরাম ফুকন, রোহিনীকুমার চৌধুরী, গোপীনাথ বরদলৈ, বিষ্ণুরাম মেধী, কামাখ্যা বরুয়া, ধানীরাম তালুকদার, যাদবচন্দ্র দাস মিলে গঠন করেছেন দলের আসাম সমিতি। মূল কংগ্রেসের মধ্যে থেকেও এরা একটু স্বতন্ত্র। বিপিনচন্দ্র খবর পেয়েছেন তাঁর ভ্রাতা এদের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছে।
এদিকে নিজের শরীরের অবস্থাও আগেকার মতো নেই। বছরে তিন চার বার শিলং আর আর বাড়ি, বাড়ি আর লক্ষীপুর দৌড়ের ধকল সহ্য করার ক্ষমতাও কমে আসছে। আর প্রিয় অনুজকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন এ স্বপ্ন কি আবার ভাঙতে চলল? এদের সঙ্গে চললে বিধান পরিষদে তাঁর কী কোনও ভবিষ্যৎ হতে পারে? হোক না ইংরেজ বিরোধী স্বদেশি, তবুও তাঁর মতো নেতৃত্বেরই যে দরকার আমাদের এ অঞ্চলের জন্য। কী নেই তাঁর? বিদ্যা, বুদ্ধি, বাক্চাতুর্য আর সাংগঠনিক দক্ষতায় তাঁর সমকক্ষ আর ক’জন আছে কংগ্রেসে? চেহারাখানা যেমন রাজপুত্রের মতো, কণ্ঠস্বরও তেমনি সুমধুর।
আজকাল বিপিনচন্দ্র মাঝে মাঝেই ভাবেন ভিতরে ভিতরে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। হাতে দিনও আর বোধহয় বেশি নেই। অনেক কাজই তো বাকি রয়ে গেল। দেশের কাজ এবং পারিবারিক কাজও সবার মুখে শুনেন ইংরেজ রাজত্ব আর বেশি দিন নেই। কেমন যেন স্বপ্নের মতো মনে হয় এসব কথা। বিগত আশি বছরে ইংরেজ রাজত্ব যে মানুষের রক্তের ভেতর ঢুকে গেছে। একদিন পদ্মনাথ বিদ্যাবিনোদ মহোদয় তাঁর ইংরেজিয়ানা দেখে হেসেছিলেন, কিন্তু এখন তো সাল গণনায় সেই খ্রিস্টাব্দেই মানুষ অভ্যস্ত। শকাব্দ তো অনেক আগেই গেছে। বঙ্গাব্দের ব্যবহার সীমিত হয়ে আসছে। আর আইন পরিষদে ক’জনই আর বাংলায় বক্তব্য রাখেন? তিনি নিজেই তো ইংরেজির উপর নির্ভরশীল। কী জানি এরা যদি কোনওদিন ক্ষমতায় আসে, নিজের ভাষাকে সেই মর্যাদা দিতে পারবে তো? এসব নানা চিন্তা তাঁর মাথায় ক্রমাগতই ঘুরপাক খেতে থাকে। তবে আপাতত বিশ্রামের প্রয়োজন। পরিষদে এসেছে নতুন প্রস্তাব, ‘সিলেট রি-ইউনিয়ন’। সিলেট কি আসামে থাকবে, না বঙ্গদেশের সঙ্গে যাবে? এই নিয়ে তাঁর সরকারি বাসভবনে একটি বৈঠক কাল সকালেই।